কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হয়
আজকে আমরা জানব কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হয়। আমাদের মধ্যে অনেকের মুখেই কিছুদিন পর পর সাধারণত ঘা হয়ে থাকে। এই মুখের ঘা তে ভোগেননি এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম।প্রায় দুইশ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পায় মুখগহ্বরে ঘা এর মাধ্যমে। বর্তমান কালের মরণঘাতী অনেক বড় রোগের লক্ষণ এই মুখের ঘা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এমনকি গর্ভাবস্থায়ও অনেক রোগের লক্ষণ মুখের ভেতরে প্রকাশ পায়। মুখে সাধারণত দুই ভাবে ঘা হয়ে থাকে। কখনো কখনো জিব্বায় ঘা হয় অথবা ঠোঁটের কোণে ঘা হতে পারে। এতে প্রচণ্ড ব্যথা করতে থাকে এবং কিছু খেতে গেলে জ্বলে।এগুলোই হচ্ছে মুখে ঘা এর প্রাথমিক লক্ষণ। অনেক সময় মুখ ফুলে যায় । তাই আজকে আমাদের আর্টিকেলের জানার বিষয় হচ্ছে কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হয় ।
মুখে ঘা এর উপসর্গ
- অ্যাপথাস আলসারের চারপাশে ব্যথা, জ্বালা, পোড়া, হালকা চুলকানোর (যদি পুঁজ জমে যায়) সমস্যা থাকে।
- অনেক সময় মুখের একাধিক জায়গায় এই ঘা হয়। তখন খাবার গিলতে, কথা বলতে বা মুখ হাঁ করতেও কষ্ট হতে পারে।
- অনেকের এই ঘা থেকে খুব বেশি জ্বালাপোড়ার জন্য একটু লালা ঝরতে পারে।
আরো পড়ুনঃ
মুখে ঘা হওয়ার কারণ সমূহ । কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হয়
- এর কারণ হচ্ছে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, ভিটামিন 'সি' বা 'ডি'র অভাব কিংবা পেট পরিষ্কার না থাকার কারণে হতে পারে মুখে ঘা। এতে বেশ জ্বালা পড়া যেমন হতে থাকে তেমনি তীব্র ব্যথা বা যন্ত্রণা অনুভূত হয়। যেহেতু আমাদের মধ্যে মুখের ঘা সচরাচর প্রত্যেকের মধ্যেই দেখা যায় তাই ব্যাপারটি হালকাভাবে নেয়ার কিছু নেই। আমাদের জানা থাকা ভাল কি কি কারণে মুখের ঘা হতে পারেবা কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হতে পারে।
- ভিটামিন ও আয়রনের স্বল্পতার কারণে মুখে ঘা হতে পারে। যেমন ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি১২ অথবা অন্য কোন ভিটামিন। ঠাণ্ডা লাগলে মুখে ঘা হতে পারে। মুখের মাড়ি আঘাতগ্রস্ত হয়েও অনেক সময় এই ঘা হয়। জোরে জোরে দাঁত ব্রাশ করলেও মুখে ঘা হতে পারে।
- ধূমপান, নেশা জাতীয় জিনিস, পান, মদ খেলেও মুখে ঘা হয়। যাদের এইডস, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এমন রোগ আছে তাদের এ ঘা হয়।
- রাতে ঘুম না হলে অথবা দেরি করে ঘুমালে, পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম না হলে অনেক বেশি দুশ্চিন্তা করলেও মুখে ঘা হতে পারে। বংশগত কারণেও মুখের ভিতর আলসার হয়। মুখে অ্যালার্জি থাকলেও এই ঘা হতে পারে।
- মুখের ভেতরের ঝিল্লি আবরণ কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুখে ছোট ছোট দানার মতো ঘা দেখা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনিতে সেরে যায়। কিন্তু বারবার মুখে ঘা হলে এবং তা না সারলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
- বিশেষ কোনো ভিটামিনের স্বল্পতা, কোনো দুশ্চিন্তা, মুখের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদি কারণে হয়।
- এছাড়াও অজান্তে মুখ বা জিবে কামড় পড়লে, শক্ত টুথব্রাশ বা সুচালো বাঁকা দাঁতের আঘাতে, দাঁত ক্ষয়রোগ এবং মুখের পরিচ্ছন্নতা বজায় না থাকলেই ঘন ঘন মুখে ঘা হয়।
ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হলে যা করনীয়
মুখ লবণ এবং গরম পানি দিয়ে কুলকুচি করতে হবে। বেকিং সোডা পানিতে মিশিয়ে কুলকুচি করলে উপকার পাওয়া যায়। সব ধরনের পানীয় যেমন চা বা কফি পরিহার করতে হবে। কাঁচা পেয়াজ খেতে পারলে বেশ উপকারে আসবে যা ঘা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
ভিটামিন সি যুক্ত ফলমূল খেতে হবে যেমন কমলা, লেবু কিংবা মরিচ। চুন কিংবা গুল মিশ্রিত পান খাওয়া পরিহার করতে হবে। পানি বেশি করে পান করতে হবে প্রতিদিন নিয়মিত আট গ্লাস করে যা পেটের যেকোনো সমস্যা থেকে দূরে রাখবে এবং মুখে ঘা হওয়া থেকে প্রতিরোধ করবে।
মাড়িতে প্লাক জমলে তা অবশ্যই স্কেলিং করিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগের সঠিক চিকিৎসা বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভিটামিন ‘বি’-র স্বল্পতা, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, মুখ অপরিষ্কার, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে
ভিটামিন ই ক্যাপসুল ঘা এর উপর ভেঙ্গে দিন। অথবা টি ব্যাগ ঘা এর উপর রেখে দিন। এতেও দ্রুত নিরাময় হয় ঘা।
সাধারণত ৭ দিনের মধ্যে এই ঘা ভালো হয়ে যায়। আর যদি তা না হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। মাউথ ওয়াশ মুখের ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে।
উপরোক্ত কাজগুলো ছাড়াও আপনি এন্টি ব্যক্টেরিয়াল জাতীয় মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করুন প্রতি রাতে ব্রাশ করার পর। সুষম খাদ্য খাওয়ার পাশাপাশি ভিটামিন সি জাতীয় ফলমূল বেশি বেশি খেতে হবে।
ভিটামিন বি এর অভাবের লক্ষণ সমূহ বা কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হয়
ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে যায়, চুল রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে , চোখের তলায় কালি পরে। আপনার শরীরে ভিটামিনের অভাব মারাত্মক। অনেক সময় কয়েকটি লক্ষণ দেখে বুঝা যায় আসলে কোন ভিটামিনের অভাব রয়েছে। আমরা কয়েকটি ভিটামিনের অভাবজনিত লক্ষণ গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
- ভিটামিন A-এর অভাবে রাতকানা, দেহের বৃদ্ধি ব্যাহত, ত্বক খসখসে, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি।
- ভিটামিন B1-এর অভাবে বেরিবেরি, হাত-পা ফোলা, স্নায়ু দুর্বল।
- ভিটামিন B2-র অভাবে মুখে, জিভে, ঠোঁটের কোণে ঘা হয়, চুল উঠতে থাকে।
- ভিটামিন B3-র অভাবে অন্ত্রে ঘা, পেশিতে টান, চর্ম রোগ, ক্লান্ত ভাব।
- ভিটামিন B5-এর অভাবে রক্তাল্পতা, ত্বক খসখসে, খাদ্যনালিতে ঘা।
- ভিটামিন B6-এর অভাবে রক্তাল্পতা, নিদ্রাল্পতা, চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা হয়।
- ভিটামিন B12-র অভাবে বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, রক্তাল্পতার সমস্যা।
- ভিটামিন C-র অভাবে দাঁতের গোড়া ফোলা, দাঁত থেকে রক্ত পড়া।
- ভিটামিন D-র অভাবে রিকেট, অস্থি ও দাঁতের বিকৃতি।
- ভিটামিন E-র অভাবে বন্ধ্যত্ব, জননাঙ্গের বৃদ্ধি ব্যাহত।
- ভিটামিন K-র অভাবে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবের কারণে আমাদের মুখ ও জিহ্বায় নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে মুখে কোন আলসার বা রোগ দেখা দিলেই যে ভিটামিন প্রয়োগ করতে হবে তা কিন্তু ঠিক নয়। সবার আগে মুখের রোগটি কি তা নির্ণয় করতে হবে এবং কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। ভিটামিনের অভাবের কারণে যদি মুখে ঘা দেখা দেয় তাহলে জানতে হবে কোন ভিটামিনের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের দেশে প্রায়ই মুখস্ত কিছু ভিটামিন সবাই সেবন করেন যা ঠিক নয়।
ভিটামিন ‘বি’ এর অভাবজণিত মুখের সমস্যা
ভিটামিন বি১২ এর অভাবে মুখও জিহ্বায় যেসব সমস্যা হয় সেগুলো হলো
- জিহ্বায় প্রদাহ বা গ্লসাইটিস।
- অ্যংগুলার স্টোমাটাইটিস বা ঠোঁটের কোনায় ঘা।
- বার বার মুখের আলসার।
- ওরাল ক্যান্ডিডোসিস।
- জিহ্বায় ক্ষত।
- মুখের মিউকাস মেমব্রেন ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
ভিটামিন ‘বি২’ এর অভাবজণিত মুখের সমস্যা ঃ
- মুখের কোনায় ঘা বা অ্যাংগুলার চিলাইটিস।
- মুখ ও জিহ্বার আবরণের প্রদাহ।
- মুখের আলসার।
- ফাটলযুক্ত লাল ঠোঁট।
- এট্রফিক ফিলিফরম প্যাপিলা।
ভিটামিন ‘বি৩’ বা নিয়াসিন এর অভাবজণিত সমস্যা ঃ
- লাল ও ব্যথাযুক্ত মুখের মিউকোসা।
- বেশী লালা নিঃসরণ।
- ইন্টারডেন্টাল প্যাপিলার ব্যাথা এবং আলসার।
- অ্যাংগুলার চিলাইটিস বা ঠোঁটের কোনায় ঘা।
ভিটামিন ‘বি৬’ বা পাইরিডক্সিন এর অভাবজণিত মুখের সমস্যা
- চিলাইটিস বা ঠোঁটের প্রদাহ
- জিহ্বার প্রদাহ হতে পারে।
ভিটামিন ‘বি৯’ বা ফলিক এসিড এর অভাবজণিত মুখের সমস্যা
- মুখের আলসার।
- জিহ্বায় ফোলাভাব।
ভিটামিন ‘ডি’ এর অভাবজণিত মুখের সমস্যা
- ভিটামিন ‘ডি’ ক্যালসিয়ামের সাথে কাজ করে থাকে হাড়ের মান ও শক্তি বজায় রাখার জন্য।
- ভিটামিন ‘ডি’ এর অভাবে মুখের চোয়ালের ফ্রাকচারের ঝুকি বেড়ে যায়।
- এছাড়া পেরিওডন্টাল রোগ হতে পারে।
- ছোট বেলায় ভিটামিন ‘ডি’ এর অভাব হলে তা দাঁতের গঠনে বিঘœ ঘটাতে পারে।
- দাঁত দেরীতে উঠে।
- দাঁতের এনামেলে ত্রুটি দেখা দেয়।
- এনামেলে ক্ষয় দেখা যায়।
ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজণিত মুখের সমস্যা
ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে মুখের কোনায় আলসার শুকাতে দেরী হয়।
ভিটামিন ‘সি’ এর অভাবজণিত মুখের সমস্যা
- মাড়ি ফুলে যেতে পারে
- মাড়ির রং পরিবর্তিত হয়
- দাঁত ধীরে ধীরে নড়ে যেতে পারে
- পেরিওডন্টাইটিস হয়ে দাঁত পড়ে যেতে পারে।
ভিটামিন ‘কে’ এর অভাবজণিত মুখের সমস্যা
- ভিটামিন ‘কে’ রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে থাকে
- মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে বিশেষ করে দাঁত ব্রাশ করার সময়
- দাঁত তোলার পর রক্ত জমাট বাঁধে না বা সমস্যা হয় অর্থাৎ দীর্ঘ সময় লাগতে পারে
কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হয়
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসক আ ফ ম হেলাল উদ্দীন বলেন, এই ঘা হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। তবু মনে করা হয়, কিছু বিষয়ের কারণে এমনটা হতে পারে।
- রক্তে আয়রন ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের অভাব।
- কিছু রক্তের অসুখ।
- অ্যালার্জিজনিত সমস্যা।
- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা।
- হঠাৎ গালে বা ঠোঁটের মাংসপেশিতে দাঁতের ধাক্কায় কেটে যাওয়ার পর সংক্রমণ হয়ে এই ঘা হতে পারে।
- মাদকদ্রব্য, অ্যালকোহল গ্রহণকারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য এই ঘা হতে পারে।
- অতিরিক্ত পান, সুপারি, জর্দা থেকে মুখের ভেতরে চামড়া উঠে, মাড়ি বা মুখের নরম মাংসপেশি ক্ষয় হয়েও এই সমস্যা হয়।
- ক্রোমোজোমের সমস্যাজনিত কারণে কিছু কিছু ক্যানসার রোগীর মুখে এই ঘা হয়।
- দাঁতের গোড়ায় সংক্রমণ, আবার অনেকের গর্ভাবস্থায়ও বারবার এই সমস্যা হয়।
- তবে এটি কোনো ছোঁয়াচে অসুখ নয়।
কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হয় এবং করণীয়
সহকারী অধ্যাপক আ ফ ম হেলাল উদ্দীনের মতে, মুখের ঘা প্রতিরোধে করণীয়—
- মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। পান, সুপারি, জর্দা, গুল, তামাক পাতা, মাদক, অ্যালকোহল, অতিরিক্ত চা, কফি বর্জনীয়।
- আয়রন ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ট্যাবলেট খেতে হবে।
- পেটের কোনো অসুখ হলে তার চিকিৎসা জরুরি।
- পানিশূন্যতা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও দাঁতের ক্যারিজ জাতীয় অসুখ থাকলে তার দ্রুত সমাধান জরুরি।
- মাউথওয়াশ দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে হবে। অথবা হালকা গরম পানিতে লবণ দিয়ে কুলি করা দরকার।
কোন ভিটামিনের অভাবে মুখে ঘা হয় সম্পর্কে শেষ কথা
কষ্ট বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।