আলহামদুলিল্লাহ, ওয়াস সলাতু ওয়াস সালামু আলা রসূলিল্লা । সম্মানিত পাঠক মুসলিম হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি নামাজ আদায় করে থাকি কারো পাঁচ ওয়াক্ত নিয়মিত আদায় করা হয় কারো বা সাপ্তাহিক শুধু জুমার নামাজ টাই পড়া হয় । তবে প্রত্যেক নামাজের পর নির্ধারিত অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে যা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানিনা।
তাই আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব কোরআন ও হাদিসের আলোকে দলিল প্রমাণ সহ ফরজ নামাজের পর আমলসমূহ কি, উপকারিতা কি ? কখন আদায় করতে হয়? কিভাবে পড়তে হয়? কতবার পড়তে হয় ?
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরানোর পর নামাজ শেষে কি কি আমল করতেন।
- এবং সাহাবায়ে কেরামকে কি কি আমল করতে বলেছেন।
- কোন কোন আমলটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল।
- কোন কোন আমলটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়েননি।
- কোন আমলটি করার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে তিনি তাকি দিয়েছেন।
জিকিরের প্রাথমিক ধারণা
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষের কৃত সকল কাজই যিকর হিসেবে বিবেচিত। সলাত, কুরআন তিলাওয়াত যেমন যিকর তেমনি কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত বিভিন্ন বাক্যও যিকর বা দূ’আ হিসেবে বিবেচিত। ফলে দু'আ ও যিকরের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেছেন, তোমরা আমাকেই স্মরণ (যিকর) কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করবো।
[সূরা বাকারা, ২:১৫২]
যিকর ও দু'আ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভই আমাদের সকল ইবাদতের লক্ষ্য। তাই প্রতিটি ইবাদত করার পূর্বে সেই ইবাদত কী, কেন করবো, কিভাবে করবো সে বিষয়গুলো জানা জরুরি। নিম্নে যিকর ও দু'আ কী সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হলো:
(১) যিকর শব্দের অর্থ স্মরণ করা বা স্মরণ করানো।
(২) দু'আ বলতে আমরা আল্লাহ সাথে কথাবার্তা, প্রার্থনা ও মুনাজাতকে বুঝি। [সহীহ ইবনে খুযাইমাঃ৪৭৪]
(৩) যেকোন প্রকারে মনে, মুখে, অন্তরে, কর্মের মাধ্যমে, চিন্তার মাধ্যমে, আদেশ পালন করে বা নিষেধ মান্য করার মাধ্যমে আল্লাহর নাম, গুণাবলী, বিধি-বিধান, তাঁর পুরস্কার, শাস্তি ইত্যাদি স্মরণ করা বা করানোকে ইসলামের পরিভাষায় যিকর বা আল্লাহর যিকর বলা হয়। [ড খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ), রাহে বেলায়েত, অনুচ্ছেদ-১.৪, পৃ.৪৫)।
(৪) মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন, "তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করিব। [সূরা বাকারা,২:১৫২]
ফরজ নামাজের পর আমল ১
الحمد لله। পাঠ করা
(সূত্র সহীহ মুসলিম ২১৩৭/১)
উচ্চারণঃ আলহামদু লিল্লাহি
ভাবানুবাদ বাংলাঃ সকল প্রশংসা আল্লার জন্য।
উপকারিতাঃ
১। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় বাক্য এটি; [সহীহ মুসলিম: ২১৩৭]
২। রাসূল (সা:)এর কাছে পৃথিবীর বুকে সূর্যের নিচে যা কিছু আছে সবকিছু থেকে বেশি প্রিয়। [সুনানে তিরমিযী:৩৫৯৭]
প্রাসঙ্গিক সময় ও পদ্ধতি
যেকোন সময় পড়া যায়।
ফরজ নামাজের পর আমল ২
أستغفر الله পাঠ করা
(সূত্র সহীহ মুসলিম ৫৯১)
উচ্চারণঃ আসতাগফিরুল্লহ
ভাবানুবাদ বাংলাঃ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ।
প্রাসঙ্গিক সময় ও পদ্ধতি
১। ফরজ সলাতের সালাম ফিরানোর পরে তিনবার এই কথাগুলো বলা। [সুনানে তিরমিযী:৩২৫৯৷
২। দিনে সত্তর বা একশত বার বা তার চেয়ে বেশি পড়া। [সহীহ মুসলিম:৫৯১]
ফরজ নামাজের পর আমল ৩
اللهم أنت السّلام ومنك السّلام تباركت ذا الجلال والإكرام
(সূত্র সহীহ মুসলিম ৫৯১)
উচ্চারণঃ আল্লহুম্মা আঙতাস সালামু ওয় মিঙকাস সালামু, তাবা-রকতা যাল জালা-লি ওয়াল ইকরম।
ভাবানুবাদ বাংলাঃ হে আল্লাহ! তুমিই শান্তিময় এবং তোমার থেকে শান্তি আসে। তুমি কল্যাণময় এবং সম্মান ও প্রতিপত্তির অধিকারী।
উপকারিতাঃ রাসূল (সা.) সালাত শেষে তিনবার ইসতিগবার বলারপর আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম বলতেন। [সহীহ মুসলিম:৫৯১]
ফরজ নামাজের পর আমল ৪
اللهم أصلح لي ديني الذي جعلته في عضمة وأصلح لي دنياي التي جعلت فيها معاشي اللهم إني أعوذ برضاك من سخطك وأعوذ بعفوك من نقمتك وأعوذ بك منك لا مانع لما أعطيت ولا معطي لما منعت ولا ينفع ذا الجد منك الجدّ
(সূত্র সুনানে নাসাঈ ১৩৪৬)
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, আস্বলি‘হ লী দীনিয়াল লাযী জা‘আল্ তাহু “ইস্বমাতা আমরী। ওয়া আস্বলি'হ লী দুন্ ইয়া-ইয়াল লাতী জা‘আলতা ফীহা মা‘আলতা ফীহা মা‘আ-শী। আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আউযু বি রিদা-কা মিন সাখাত্বিকা, ওয়াবি ‘আউযুবিকা মিন নিক্বমাতিকা,ওয়া আঊযু বিকা মিনকা। আল্লা-হুম্মা, লা-মা-নি-আ লিমা- আ‘তাইতা, ওয়ালা-মু‘অত্বিয়া লিমা আমা‘তা, ওয়া লা-ইয়ানফা'উ যাল জাদ্দি মিনকাল জাদ্দু।
ভাবানুবাদ বাংলাঃ হে আল্লাহ, আপনি আমার দ্বীনকে সংশোধিত- কল্যাণময় করুন, যাকে আপনি আমার রক্ষাকবজ বানিয়েছেন এবং পার্থিব জীবনকে সংশোধিত করুন, যাতে আমার জীবন ও জীবিকা রেখেছেন। হে আল্লাহ, আমি আপনার অসন্তষ্ঠি থেকে আপনার সন্তষ্টির নিকট, আপনার শাস্তি থেকে আপানার ক্ষমার নিকট এবং আপনার থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ, আপনি যা প্রদান করেন তা ঠেকানোর কেউ নেই। এবং আপনি যা প্রদান না করেন তা প্রদান করার ক্ষমতা ও কারো নেই। এবং কোনো পারিশ্রমকারীর পরিশ্রম আপনার ইচ্ছার বাইরে তার কোনো উপকারে লাগে না ।
ফরজ নামাজের পর আমল ৫
الله لا إله إلا هو الحي القيوم لا تأخذه سنة ولا نوم له ما في السموات وما في الأرض * من ذا الذي يشفع عنده إلا بإذنه يعلم ما بين أيديهم وما خلفهم ولا يحيطون بشيء من علية إلا بما شاء وسع كرسيه السموات والأرض ولا يتوده حفظهما وهو
العلي العظيم ۲۵۵۰
(সূত্র আল বাকারা ২৫৫)
উচ্চারণঃ আল্ল-হু লাইলা-হা ইল্লা হুওয়া আল হাইয়ুল ক্বাইয়ূম। লা-তা খুযুহূ ছিনাতুওঁ ওয়ালা-নাওম। লাহু মা ফিছ ছামা-ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্। মাও যাল্লাযী ইয়াশফাউ “ইনদাহু ইল্লা বিইযনিহ। ইয়া'লামু মা বাইনা আইদীহিম, ওয়ামা খলফাহুম ওয়ালা ইউহীতুনা বিশাইইম মিন ইলমিহী ইল্লা-বিমা-শাআ। ওয়াছি আ কুরছিইয়ুহুছ ছামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্ব। ওয়ালা ইয়াউদুহু হিফজু হুমা। ওয়া হুওয়াল আলিইয়ূল আজীম।
ভাবানুবাদ বাংলাঃ আল্লাহ্, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নাই। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। তাঁহাকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে সমস্ত তাঁহারই। কে সে, যে তাঁহার অনুমতি ব্যতীত তাঁহার নিকট সুপারিশ করিবে? তাহাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যাহা কিছু আছে তাহা তিনি অবগত। যাহা তিনি ইচ্ছা করেন তদ্ব্যতীত তাঁহার জ্ঞানের কিছুই তাহারা আয়ত্ত করিতে পারে না। তাঁহার ‘কুরসী' আকাশ ও পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত; ইহাদের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁহাকে ক্লান্ত করে না; আর তিনি মহান, শ্রেষ্ঠ।
উপকারিতাঃ
১। যে ব্যক্তি সকালে আয়াতুল কুরসী তিলাওয়াত করবে সে বিকাল পর্যন্ত আর যে বিকালে তিলাওয়াত করবে সে সকাল পর্যন্ত আল্লাহর হেফাজতে থাকবে; [সুনানে তিরমিযী: ২৮৭৯]
২। রাসূল (সা.) এর নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয় আয়াত হলো এই আয়াতুল কুরসী; [সহীহ মুসলিম: ৮১০]
৩। কুরআনের সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ আয়াত হলো আয়াতুল কুরসী; [সুনানে আবু দাউদ:৪০০৩]
৪। রাতে ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসী পড়লে রাতের পুরো সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য হেফাযতকারী থাকবে এবং সকাল হওয়া পর্যন্ত শয়তান তার নিকটেও আসতে পারবে না। [সহীহ বুখারী : ২৩১১)
৫। যেখানে আয়াতুল কুরসী পাঠ করা হয় সেখানে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না; [সুনানে তিরমিযী: ২৮৮]
৬। যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ সলাতের পর আয়াতুল কুরসী তিলাওয়াত করবে তার জান্নাতে যাওয়ার পথে একমাত্র বাধা হচ্ছে মৃত্যু: [নাসাঈ আসসুনানুল কুবরা: ৯৯২৮]
প্রাসঙ্গিক সময় ও পদ্ধতি
১। রাতে ঘুমানোর আগে। [সহীহ বুখারী: ২৩১১]
২। সকাল-বিকাল। [সুনানে তিরমিযী: ২৮৭৯]
৩। প্রতি ওয়াক্তের ফরজ নামাজের পর। [নাসাঈ আস-সুনানুল কুবরা : ৯৯২৮]
ফরজ নামাজের পর আমল ৬
رب قني عذابك يوم تبعث أو تجمع
عبادك .
(সূত্র সহীহ মুসলিম ৭০৯/১)
উচ্চারণঃ রব্বি ক্বিনী ‘আযা-বাকা ইয়াওমা তাব‘আসু আও তাজমাউ ইবা-দাকা।
ভাবানুবাদ বাংলাঃ হে রব! আমাকে তোমার সে দিনের আযাব থেকে বাঁচাও, যে দিন তুমি তোমার বান্দাদের পুনরায় জীবিত করবে কিংবা একত্রিত করবে।
ফরজ নামাজের পর আমল ৭
اللهم إني أعوذ بك من الكفر والفقر
وعذاب القبر
(সূত্র সুনানে নাসাঈ ১৩৪৭)
উচ্চারণঃ আল্লহুম্মা, ইন্নী আউযু বিকা মিনাল কুফরি ওয়াল ফাকরি, ওয়া আযাবিল কবরি।
ভাবানুবাদ বাংলাঃ হে আল্লাহ, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি কুফরি থেকে ও দারিদ্র্য থেকে এবং কববের আযাব থেকে।
ফরজ নামাজের পর আমল ৮
اللهم أعني على ذكرك وشكرك وحسن
عبادتك
(সূত্র সুনানে আবু দাউদ ১৫২২)
উচ্চারণঃ আল্ল-হুম্মা, আ‘ইননী ‘আলা-যিক রিকা ওয়া শুকরিকা ওয়া হুসনি “ইবা-দাতিক।
ভাবানুবাদ বাংলাঃ হে আল্লাহ! আপনার স্মরণে, আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে এবং আপনার উত্তম ‘ইবাদাতে আমাকে সাহায্য করুন
উপকারিতাঃ রাসূল (সা.) বলেন,হে মুআয! আল্লাহর শপথ, আমি তোমাকে ভালবাসি। তারপর তিনি আমার হাত ধরে আমাকে ওসয়িত করলেন যে,তুমি নামায পরার পর এই দু'আ কোন সময় ত্যাগ
করবে না। [সুনানে আবু দাউদ:১৫২২]
ফরজ নামাজের পর আমল ৯
اللهم إني أعوذ بك من البخل، وأعوذ بك من الجبن، وأعوذ بك أن أرد إلى أرذل العمر، وأعوذ بك من فتنة الدنيا، وأعوذ بك من عذاب القبر
(সূত্র সহীহ বুখারী ৬৩৭০)
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা, ইন্নী আ'ঊযু বিকা মিলাল বুখলি ওয়া আ'উযু বিকা মিনাল জুবনি ওয় আউযু বিকা আন উরাদ্দা ইলা –আরযালিল উমুরি ওয়া আ'উযু বিকা মিন ফিতনাতিদ দুনইয়া-ওয়া আ'ঊযু বিকা মিন ‘আযা-বিল ক্বাবরি।
ভাবানুবাদ বাংলাঃ হে আল্লাহ, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি কৃপণতা থেকে, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি কাপুরুষতা থেকে, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি কাপুরুষতা থেকে, আপনি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি অপমানকর অতি বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছান থেকে, (যে বয়স মানুষ কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে), আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুনিয়ার ফিতনা থেকে, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি করবের আযান থেকে।
ফরজ নামাজের পর আমল ১০
اللهم اغفر لي ما قدمت وما أخرت ، وما أسررت وما أعلنت ، وما أشرفت ، وما أنت أعلم به مني أنت المقدم وأنت المؤخر لا إله إلا أنت
(সূত্র সুনানে আবু দাউদ ১৫০৯)
উচ্চারণঃ আল্লহুম্মাগ ফিরলী মাদ্দামতু, ওয়ামা-আখখরতু, ওয়ামা-আসররতু, ওয়ামা আলাঙতু, ওয়ামা-আসরফতু, ওয়ামা-আঙতা আলামু বিহী মিন্নী। আঙতাল মুক্বাদ্দিমু, ওয়া আঙতাল মুআখখিরু, লাইলা-হা ইল্লা-আঙতা।
ভাবানুবাদ বাংলাঃ হে আল্লাহ, আপনি আমার জন্য ক্ষমা করুন আমি আগে যা করেছি এবং পরে যা করেছি, গোপনে যা করেছি এবং প্রকাশ্যে যা করেছি এবং বাড়াবাড়ি করে যা করেছি এবং যা আপনি আমার চেয়েও বেশি জানেন। আপনিই অগ্রবতী করেন, আপনিই পিছিয়ে দেন। আপনি ছাড়া কোনো মা'বুদ নেই।