মসলিন কি কেবলই কাপড়? এই বাংলাদেশের ঐতিহ্যের কথা বললে, ইতিহাসের কথা বললে মসলিনকে বাদ দেওয়ার কোনো উপায়ই যে নেই। তাই তো মসলিনের পুনর্জন্ম ঘটাতে ছয় বছর ধরে লেগে ছিলেন একদল গবেষক। অবশেষে তাঁরা সফলও হয়েছেন। কী বিচিত্র উপায়ে সংগ্রহ করা হলো মিহি মসলিনের উপাদানগুলো, তা একেকটা গল্পই বটে।
ঢাকাই মসলিনের শেষ প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে ১৮৫০ সালে। এর ১৭০ বছর পরে বাংলাদেশে আবার বোনা হলো সেই ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন কাপড়ের শাড়ি। ঠিক সে রকমই, যেমনটি বলা হতো—আংটির ভেতর দিয়ে গলে যায় আস্ত একটি শাড়ি। ইতিমধ্যেই ঢাকাই মসলিনের জিআই স্বত্বের অনুমোদন পাওয়া গেছে। ২৮ ডিসেম্বর এ–সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।
প্রচলিত আছে, মসলিন শিল্পীদের আঙুল কেটে দেওয়ার পরে ঢাকাই মসলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। এখন ভারতেও মসলিন তৈরি হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাই মসলিনের বিশেষত্বই আলাদা। তাই তো ঢাকাই মসলিন তৈরির জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন একদল গবেষক। তাঁদেরই ছয় বছরের চেষ্টা আর গবেষণা ফল দিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে মসলিনের ছয়টি শাড়ি। যার একটি গবেষকেরা প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন।
কিন্তু শুরুতে এক টুকরা ‘অরিজিনাল’ মসলিন কাপড় জোগাতে কলকাতা থেকে লন্ডন পর্যন্ত ছুটতে হয়েছে গবেষকদের। মসলিন বোনার সুতা যেই ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার গাছ থেকে তৈরি হয়, সেই গাছ খুঁজে বের করা হয়েছে বিচিত্র সব পন্থা অবলম্বন করে। যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে এসেও এই শাড়ি তৈরিতে তাঁতিদের হাতে কাটা ৫০০ কাউন্টের সুতাই ব্যবহার করতে হয়েছে। কাপড়ও বোনা হয়েছে হস্তচালিত তাঁতেই।
গোড়ার কথা: ২০১৪ সালের অক্টোবরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারের নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির অন্যান্য সদস্য হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ আলীমুজ্জামান, বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত পরিচালক মো.আখতারুজ্জামান, বিটিএমসি ঢাকার মহাব্যবস্থাপক মাহবুব-উল-আলম, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপমহাব্যবস্থাপক এ এস এম গোলাম মোস্তফা ও সদস্যসচিব করা হয় তাঁত বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মো. মঞ্জুরুল ইসলামকে।
পরে গবেষণাকাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে এই কমিটিতে যুক্ত করা হয়। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুলবন ওসমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম ফিরোজ আলম, অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিল বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী ও বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রাজশাহীর গবেষণা কর্মকর্তা মো. আবদুল আলিম।
কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাঁদের প্রথম কাজ ছিল যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনকে। আর প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আয়ুব আলী।
কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাঁদের প্রথম কাজ ছিল যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। সেই গাছটি আসল ফুটি কার্পাস কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার মসলিন কাপড়ের প্রয়োজন ছিল। এই দুটি জিনিস জোগাড় করাই এই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।
ফুটি কার্পাসের খোঁজে: প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক মো. মনজুর হোসেন জানান, মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই ছিল তাঁর দলটির প্রধান কাজ। কিন্তু হাতে কোনো মসলিন কাপড়ের নমুনা নেই, নেই ফুটি কার্পাসের কোনো চিহ্নও। ছিল শুধু সুইডিস গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা ‘স্পেসিস প্লান্টেরাম’, আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’–এর মতো কিছু বই।
এর মধ্যে ক্যারোলাস লিনিয়াসের বইতে মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’ উপযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। এই গাছ পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে চাষ হতো বলে সেখানে লেখা রয়েছে। অধ্যাপক মনজুর হোসনে বলেন, ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়।
গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিটিভিতে প্রচার করা হয়। এর মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এটা দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকার একটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. তাজউদ্দিন ফুটি কার্পাসের সন্ধান চেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল–কলেজে প্রচারপত্র বিলি করেন এবং মাইকিং করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু; বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে নেওয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কাণ্ড ও ফুল। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান। সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের এই জাতটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের নিজস্ব মাঠে ও আইবিএসসির মাঠে চাষ করা হয়।
কলকতা থেকে লন্ডন: একইভাবে স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন কাপড় সংগ্রহ করার জন্য ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর তাঁরা প্রায় দুই হাজার ফোন পান। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৮টি কাপড়ের নমুনা পাওয়া যায়। গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরোনো সিল্কের কাপড়।
দেশের অন্য কোনো উৎস থেকে মসলিনের নমুনা না পেয়ে তাঁরা জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেন। গবেষকদের দরকার ছিল চার বাই চার ইঞ্চির এক টুকরো ঢাকাই মসলিন কাপড়। কিন্তু কিছুতেই তাদের নমুনা দিচ্ছিল না জাদুঘর। এমনকি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসার পরেও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের মসলিনের নমুনা দেয়নি।
গবেষক দলটি জাতীয় জাদুঘরের নমুনার আশায় প্রায় আট মাস পার করে ফেলেন। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য তাঁরা ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যান। এই মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুর্শিদাবাদে এখন যে মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে করা হয়, যা ঢাকাই মসলিনের মতো মোলায়েম নয়।
তাঁদের মতে, ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে হলে ঢাকার আশপাশ থেকে জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে সেই এলাকাতেই করতে হবে। মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে–সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না। গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরোনো সিল্কের কাপড়।
ভারতে গিয়ে বিফল হয়ে গবেষক দল হতাশ হয়ে পড়েন। অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, এই খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যেতে বলেন। তিনি সেখানে ঢাকাই মসলিন দেখে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত মসলিনের একটু নমুনার জন্য ২০১৭ সালের জুলাইয়ে কমিটির তিন সদস্যসহ চার সদস্যের একটি দল লন্ডনের ওই মিউজিয়ামে যান। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য–উপাত্ত তাঁরা পেয়ে যান।
অবশেষে সেই ফুটি কার্পাস: লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার একটি জাতের ফুটি কার্পাস গাছের মিল পেলেন অবশেষে। তাঁরা নিশ্চিত হন, সেটিই তাঁদের কাঙ্ক্ষিত জাতের ‘ফুটি কার্পাস’। স্থানীয় আবদুল আজিজ নামের এক ব্যক্তি এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেওয়া হয়। এত কিছু করার পরে অবশ্য জাতীয় জাদুঘরে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়। প্রকল্প পরিচালক জানান, তাঁরা দেখেছেন, জাদুঘরের শুধু একটি পাগড়ি ঢাকাই মসলিনের তৈরি।
৫০০ কাউন্টের সুতা: এক কিলোমিটার সুতাকে ওজন করলে যত গ্রাম হয়, তা দিয়ে সুতার দৈর্ঘ্যকে ভাগ করলে কাউন্ট পাওয়া যায়। যেমন ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সুতার ওজন যদি ২ গ্রাম হয়, তাহলে ২ দিয়ে ১০০০ মিটারকে ভাগ করলে ভাগফল হয় ৫০০। এই ভাগফলকেই কাউন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত ৫০০ কাউন্ট সুতা দিয়ে মসলিন কাপড় বোনা হতো।
একটি শাড়িতে ১৪০ থেকে ১৫০ গ্রাম সুতার প্রয়োজন পড়ে। এই প্রকল্পের প্রশিক্ষিত সুতা কাটুনিরা এখন পাঁচ দিনে এক গ্রাম সুতা কাটতে পারেন। অর্থাৎ এই গতিতে একজন যদি মসলিনের সুতা কাটতে থাকেন, তাহলে একটি শাড়ি জন্য সুতা তৈরি করতে তাঁর প্রায় দুই বছর লাগার কথা। বহুদিন ঘোরাঘুরির পর তাঁরা হাসু ও নূরজাহান নামের অশীতিপর দুই বৃদ্ধার সন্ধান পান। তাঁরা বলতে পেরেছেন তাঁদের পূর্বপুরুষেরা মসলিন সুতা কাটতেন। তাঁদেরও ছোটবেলায় মিহি সুতার স্মৃতি রয়েছে।
তুলা থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। সুতা তৈরির কাজের নেতৃত্ব দেন কমিটির সদস্যসচিব ও তাঁত বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মঞ্জুরুল ইসলাম। এবার খোঁজ শুরু হয় দেশের কোথায় এখনো তাঁতিরা চরকায় সুতা কাটেন। খবর আসে, কুমিল্লার চান্দিনায় এখনো এই তাঁতিরা রয়েছেন। তাঁরা খদ্দরের জন্য চরকায় মোটা সুতা কাটেন। তবে সেই সুতা কাউন্টের মাপেই আসে না। তা সর্বোচ্চ আট-দশ কাউন্টের হতে পারে। তবু গবেষকেরা সেখানেই ছুটে যান।
তাঁরা ভাবেন, এমন তো হতে পারে যে তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ মসলিন সুতা কেটেছিলেন। বহুদিন ঘোরাঘুরির পর তাঁরা হাসু ও নূরজাহান নামের অশীতিপর দুই বৃদ্ধার সন্ধান পান। তাঁরা বলতে পেরেছেন তাঁদের পূর্বপুরুষেরা মসলিন সুতা কাটতেন। তাঁদেরও ছোটবেলায় মিহি সুতার স্মৃতি রয়েছে। তাঁদের পেয়ে গবেষক দল যেন সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আশার আলো দেখেন। কিন্তু তাঁরা তো এখন সুতা কাটতে পারেন না।
মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা খদ্দরের মোটা সুতাকাটুনিদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের পাঁচজন করে আটটি দলে ভাগ করেন। প্রতিটি দলের মধ্যে সুতা চিকন করার প্রতিযোগিতা করা হয়। প্রতিটি দলের সেরাদের নিয়ে আবার দল গঠন করা হয়। এভাবে ছয়জন সেরা সুতাকাটুনি বের করতেই তাঁদের দুই বছর সময় লেগে যায়।
এই ছয়জনই প্রশিক্ষক হয়ে গেছেন। তাঁদের একজনকে দিয়ে আরও ১১ জনকে শেখাতে সময় লেগেছে মাত্র ছয় মাস। এ রকম ১০০ জন তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। নতুন করে এই সুতা কাটার জন্য চরকা তৈরি করেন মঞ্জুরুল ইসলাম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক আলীমুজ্জামান।
তিন আঙুলের জাদু: সুতা মিহি করার ব্যাপারটা আসলে তিন আঙুলের জাদু। তিন আঙুলে কীভাবে তুলা ছাড়তে হবে, সেটাই আবিষ্কার করতে হয়েছে। আর নারীদের আঙুলেই এই সুতা সবচেয়ে মিহি হয়। তিনটি আঙুলকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নরম করে রাখতে হয়। প্রথমে তাঁদের আঙুলগুলো শক্ত ছিল। অনুভূতি ছিল না। পরে তাঁদের আঙুলের ‘ট্রিটমেন্ট’ করতে হয়েছে। সন্ধ্যারাতে তিনটি আঙুলে লোশন মাখিয়ে রেখে সকালে সুতা কাটা হতো। আর সব সময় আঙুল তিনটির যত্ন নিতে হয়েছে।
যাতে এই তিন আঙুলে কোনো আঁচড় না লাগে বা এই তিনটি আঙুল দিয়ে অন্য কোনো জিনিস কাটাকুটির কাজ ওরা না করে। আবার কখনো কাজ করতে গেলে আঙুল ঘেমে যেত, তখন আবার পাউডার দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর চারকার এক ফাঁকে তাঁরা কতটুকু সুতা ছাড়বেন, এ ব্যাপারে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একাগ্রতা তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। এটা বড় একটা ব্যাপার। কারণ, এর যান্ত্রিক কোনো মাপ নেই। সম্পূর্ণ মনোযোগের মাধ্যমেই চরকার ঘূর্ণনের সঙ্গে সুতা ছাড়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
সুতা নিয়ে তাঁতির দুয়ারে: মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘একটা ভরসা ছিল যে আমাদের দেশে জামদানি তৈরি হয়। জামদানিতে ১৫০ কাউন্টের সুতা লাগে। জামদানি আসলে নিম্নমানের মসলিন। এ জন্য আশাবাদী হয়েছিলাম কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ৩০০ কাউন্টের সুতা নিয়ে তাঁতিদের দুয়ারে দুয়ারে আমরা ঘুরেছি। তাঁরা বলেছেন, এটা সম্ভব নয়। খামাখা এগুলো নিয়ে ঘুরছেন। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। একপর্যায়ে আমরা নারায়ণগঞ্জে সেই কাঙ্ক্ষিত তাঁতিকে পেয়ে যাই। তাঁরা হচ্ছেন রুবেল মিয়া ও মো. ইব্রাহিম।’
একটা ভরসা ছিল যে আমাদের দেশে জামদানি তৈরি হয়। জামদানিতে ১৫০ কাউন্টের সুতা লাগে। জামদানি আসলে নিম্নমানের মসলিন। এ জন্য আশাবাদী হয়েছিলাম কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ৩০০ কাউন্টের সুতা নিয়ে তাঁতিদের দুয়ারে দুয়ারে আমরা ঘুরেছি। তাঁরা বলেছেন, এটা সম্ভব নয়।
বুনোন পূর্বপ্রস্তুতি: চিকন সুতা। ঘর্ষণ থেকে ক্ষয় রোধের জন্য মাড় দেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু গতানুগতিক মাড়ে কাজ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে তাঁরা চিকন ধানের খইয়ে মাড় ব্যবহার করে কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন। আবার মাড় দিয়ে নাটাইয়ে জড়াতে গিয়ে বারবার ছিঁড়ে যায়। কীভাবে করলে ছিঁড়বে না। সেটাও বের করা হলো। শুকানো হলো। ববিনে ভরতে গেলেও বারবার ছিঁড়ে যায়। প্রতিটি পদক্ষেপই নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়েছে। টানা তৈরি করতে গিয়েও একই অবস্থা।
বিমের মধ্যে সহজভাবে যাতে ববিন ঘুরতে পারে, এ জন্য কাঠামোগত দিকটা ঠিক করে নিতে হয়। এই চিকন সুতা দিয়ে বিমে জড়ানো ও সানা করতে হয়েছে। চিকন সুতার কারণে আঙুলে লেগেই সুতা ছিঁড়ে যায়। আধা ঘণ্টার কাজ চার ঘণ্টা ধরে করতে হয়েছে। বেশি শীতেও হয় না বেশি গরমেও হয় না। মাটির গর্তে তাঁত বসিয়ে করা হয়। মাটির আর্দ্রতার সঙ্গে মসলিনের একটা সম্পর্ক আছে। সুতা বারবার ছিঁড়ে যাওয়া রোধ করার জন্য বালতিতে পানি রেখেও কাজ করতে হয়েছে।
অবশেষে বোনা হলো: এই দুই তাঁতিকে কাপড় বোনাতেও ধাপে ধাপে অনেক কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। প্রথমে একটি তাঁত করা হয়েছিল। পরে তিনটি করা হয়েছে। এই তাঁতেই রুবেল ও ইব্রাহিম ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন।লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে।
সেখানেই রয়েছে ১৭১০ সালে বোনা সেই শাড়িটি। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গবেষকদের প্রত্যাশা, এই খরচ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। ইতিমধ্যে তাঁরা মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করেছেন। একটি শাড়ি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। ছয় বছরে ব্যাপক ঘোরাঘুরি, কলকাতা–লন্ডন করেও খরচ হয়েছে সোয়া ৪ কোটি টাকার মতো।
প্রকল্পের পরিচালক আইয়ুব আলী আশা করছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এই শাড়ি সর্বসাধারণের জন্য বাজারে আনা সম্ভব হতে পারে। প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। ছয় বছরে ব্যাপক ঘোরাঘুরি, কলকাতা–লন্ডন করেও খরচ হয়েছে সোয়া ৪ কোটি টাকার মতো। বরাদ্দের অবশিষ্ট প্রায় ৭০ শতাংশ টাকা সরকারের খাতে ফেরত দেওয়া হয়েছে। তথ্যসূত্র: প্রথমআলো।