ছাদ নিয়ে বাঙালির রোম্যান্টিকতার শেষ নেই। বাংলার গল্পে-উপন্যাসে বারবার ফিরে এসেছে ছাদ আর চিলেকোঠার প্রসঙ্গ।
কলকাতা শহরে তরুণ বাঙালি সঙ্গীতশিল্পীরা নিয়মিত আয়োজন করেন রুফটপ কনসার্ট। আবার এই ছাদ থেকেই আপনি শুরু করতে পারেন আগামী ব্যবসা।
খুব বেশি আয়োজনের প্রয়োজন নেই, সামান্য খরচেই শুরু করতে পারেন আপনার এই ব্যবসা। প্রয়োজন একটি খোলামেলা মোটামুটি বড় আয়তনের একটি ছাদ। এই জায়গাটা ব্যবহার করেই শুরু হবে আপনার ব্যবসা।
ব্যবসার ধরন বা বিষয় মূলতঃ নির্ভর করবে আপনার বাড়ির অবস্থানের ওপর। গ্রাম, মফস্বল বা শহর প্রতিটি এলাকার নিজস্ব চরিত্র রয়েছে, রয়েছে নিজস্ব চাহিদা।
বাড়ির ছাদের শুরু করা যায় এরকমই সাতটি ব্যবসার আইডিয়া এখানে রইল। আপনার সামর্থ্য ও এলাকার চাহিদার ওপর নির্ভর করে বেছে নিন আপনার ব্যবসা, আর নাম মাত্র বা বিনা বিনিয়োগে শুরু করুন আপনার ব্যবসা।
১. জৈব চাষ বা অর্গ্যানিক ফার্মিং- শাক,সব্জি ও ফুলের বাগান
ক্ষতিকারক রাসানিক সার ও কীটনাশকের প্রভাব এড়াতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ক্রমশই জৈব চাষ বা অর্গ্যানিক ফার্মিংয়ে ঝুঁকছেন। শহরে জৈব চাষের জন্য জায়গা সংকুলান করা কঠিন, আর আপনার বাড়ির ছাদ হতে পারে এই কাজের জন্য আদর্শ।
টমোটো, বেগুন, লঙ্কা, কুমড়ো, লাউ, ফুলকপি, বাধাকপি, ঢেঁড়শ, শিম, ঝিঙ্গে, ক্যাপসিকাম, করলা, কড়াইশুটি, শসা, কলমী শাক, পুঁই শাক ইত্যিদি নানারকম সব্জিই ছাদে চাষ করা সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে চাইলে এক সময়ে একটি বা দুটির বেশি ফসল চাষ করা উচিত্ না।
বাঁশ দিয়ে চারকোণা বাক্সের কাঠামো বানিয়ে নীচে কাঠ ও তারওপর পলিথিনের আস্তরণ দিয়ে তারমধ্যে চাষ করা যেতে পারে। এছাড়া বড় ড্রামকে লম্বালম্বি কেটে তার মধ্যে পলিথিন দিয়ে টব তৈরি করা যেতে পারে। জৈবসার মিশ্রিত মাটি দিয়ে তার মধ্যে বীজ ছড়িয়ে বা চারা পুঁতে চাষ করা যেতে পারে।
এই ব্যবসা শুরু করতে হলে আপনাকে জৈব চাষের কলা কৌশল শিখে নিতে হবে। যথেষ্ট জানাবোঝা তৈরি হলে তবেই শুরু করুন ব্যবসা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ আর যত্ন করতে হবে ফসলের।
শাক-সব্জির পাশাপাশি চাষ করতে পারেন ফুল বা ফলও। আম, জাম, লিচু, জলপাই, ডালিম, পেয়ালা, কমলা লেবু, বাতাবি লেবু, সফেদা ইত্যাদি নানরকম ফলই চাষ করা যায় ছাদের বাগানে। পাশাপাশিই চাষ করা যেতে পারে গোলাপ, জবা, গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি বিভিন্ন ফুল।
২. মাশরুম চাষ
অন্যান্য শাক সব্জি ছাড়াও বাড়ির ছাদে খুব সহজেই মাশরুম চাষ করা সম্ভব। এই চাষ লাভজনকও বটে। মাশরুম চাষের জন্য প্রয়োজন অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। খেয়াল রাখতে হবে সূর্যের আলো যাতে প্রবেশ করতে না পারে। সে জন্য ছাদের ছায়াযুক্ত জায়গায় বাঁশের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। সূর্যের আলো যাতে না ঢোকে সে জন্য বাঁশের চালার ঘরে মাটি লেপতে হবে। মাশরুম সারা বছরই চাষ করা সম্ভব তবে বর্ষা ও শীতে ফলন ভাল হয়। খুব গরম পড়লে বাঁশের চালার গায়ে ভিজে বস্তা ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মাশরুম চাষে কোনও কীটনাশক ব্যবহার করবেন না এবং আশ পাশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখবেন, না হলে মাশরুম ফ্লাইয়ের উপদ্রব শুরু হবে।
৩. রুফটপ রেঁস্তোরা বা ক্যাফে
এই ব্যবসাটিও মূলতঃ শহরাঞ্চলের জন্যই উপযুক্ত। শহরতলি ও মফস্বলেও দ্রুত বাড়ছে চটজলটি খাবার আর ক্যাফের রমরমা। আপনার ছাদে যদি যথেষ্ট জায়গা থাকে এবং অবস্থানগতভাবে তা ক্যাফে বা রেঁস্তোরার জন্য উপযুক্ত হয় তবেই এই ব্যবসা করা সম্ভব।
প্রথমেই মেনুতে খুব বেশি পদ রাখার প্রয়োজন নেই। খুব প্রচলিত কিছু চটজলদি খাবার ও পানীয় নিয়েই শুরু করতে পারেন ক্যাফে। নজর রাখুন অন্দরসজ্জার দিকে। সবরকম আবহাওয়াতেই যাতে অতিথিরা আরাম করে বসতে পারেন সেদিকে নজর রাখুন।
মূলতঃ অল্পবয়েসী ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে মেনু ও অন্দরসজ্জা ঠিক করুন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থেকে উপযুক্ত অনুমতি নিতে ভুলবেন না।
৪. অনুষ্ঠান বা ইভেন্টে ভাড়া দেওয়া
“আমাদের ছাদে” থেকে “ছাদের পাঁচালি” – রুফটপ কনসার্ট আজকের প্রজন্মের কাছে একটি জনপ্রিয় ধারণা। শিলাজিত্ থেকে চন্দ্রবিন্দুর উপল, নিজেদের বাড়ির ছাদে কনসার্টের আয়োজন করে থাকেন নিয়মিত। আপনার ছাদেও যদি যথেষ্ট জায়গা থাকে তাহলে ন্যূনতম কিছু পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করে ভাড়া দিতে পারেন কনসার্ট বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানের জন্য।
অনেক তরুণ শিল্পীর পক্ষেই অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় না। তাদের জন্য আপনার ছাদ হয়ে উঠতে পারে অনুষ্ঠানের আদর্শ জায়গা। ছাদের ওপর আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে রিহার্সাল স্পেস হিসেবেও ভাড়া দিতে পারেন আপনার ছাদ। ভাড়া নিন ঘন্টা হিসেবে।
এছাড়াও জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীর মতো ছোট ঘরোয়া অনুষ্ঠানের জন্যও আপনার ছাদ ভাড়া দিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে এর জন্য পাড়া প্রতিবেশীর যেন কোনও সমস্যা না হয়। শব্দ সীমা বা হইহুল্লোড় যেন তাদের ঘরে না পৌঁছয় বা রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর যাতে অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
৫. মৌমাছি চাষ
মৌমাছি চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা যা আপনি শুরু করতে পারেন আপনার ছাদে। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষতা ও জ্ঞান। মৌমাছি চাষের জন্য ছায়াযুক্ত ও শুকনো জায়গা প্রয়োজন, প্রয়োজন আশেপাশে মৌমাছির উপযুক্ত খাবারের যোগান। প্রয়োজনে গাছ লাগানো যেতে পারে।
গ্রাম বা শহরতলিই এই ব্যবসার জন্য আদর্শ। মৌচাক থেকে পাওয়া মধু ও মোম বিক্রি করে লাভ হবে ভালই।
৬.সোলার প্যানেল বা সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন
আপনার বাড়ির ছাদে স্যোলার প্যানের বসিয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন করে আপনার নিজের বাড়ির ও প্রতিবেশিদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারেন। এই চাহিদা রয়েছে এমন জায়গাতেই এই ব্যবসা সম্ভব।
অনেক বেসরকারি কোম্পানিই বাড়ির ছাদে প্যানেল বসানোর কাজ করবে। আপনার এলাকায় কোন কোম্পানি এই কাজ করে সে বিষয় খোঁজ নিন, জেনে নিন খরচ। সেই মতো হিসেব করে শুরু করুন ব্যবসা।
৭. মোবাইল টাওয়ার
মোবাইল টাওয়ার বসানোর জন্য ভাল টাকা ভাড়া দেয় মোবাইল কোম্পানিগুলো। জায়গার অভাবে তারা অনেক সময়ই বাড়ির ছাদে টাওয়ার বসাতে আগ্রহী হয়।
নিয়মিত ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি টাওয়ারের দেখভাল করার জন্য বাড়ির কোনও এক ব্যক্তিকে মাসিক পারিশ্রমিকও দেয় মোবাইল সংস্থা। উভয়ের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী মাসিক বা বাত্সরিক হিসেবে টাকা দেয় এই কোম্পানিগুলো।
কোন সংস্থা টাওয়ার বসাতে আগ্রহী বা কারা বেশি টাকা দেবে আপনাকে সে বিষয় ওয়াকিবহাল হতে হবে। একবার মোবাইল টাওয়ার বসে গেলে বাড়ি বসে প্রায় বিনা পরিশ্রমেই নিয়মিত আয় করতে পারবেন আপনি।
বাড়ির ছাদের জায়গাটি ব্যবহার করে স্বল্প বিনিয়োগেই নানা ধরণের ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। উপরের ব্যবসাগুলো ছাড়াও নিজের এলাকার চাহিদা অনুযায়ী অন্য ধরণের ব্যবসার কথা ভাবতে পারেন।
তবে আপনার ছাদ সেই ব্যবসার জন্য উপযুক্ত কি না, আপনার সেই বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা ও পারদর্শীতা রয়েছে কি না এবং স্থানীয় মানুষের সমর্থন আপনি পাচ্ছেন কি না এই তিনটে প্রশ্নই ব্যবসার সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।