২০১৮ সালে প্রকাশিত ষষ্ঠ অর্থনৈতিক আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের উদ্যোগপতিদের মধ্যে ১৩.৭৬ শতাংশ মহিলা। অর্থাত্ ভারতের মোট ৫ কোটি ৮৫ লক্ষ উদ্যোগপতির মধ্যে মহিলা উদ্যোগপতির সংখ্যা মাত্র ৮০.৫ লক্ষ।
স্বাভাবিকভাবেই দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই সংখ্যাটা বাড়ানো একান্তই প্রয়োজনীয়। সারা পৃথিবীজুড়েই মহিলা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে। মহিলাদের ব্যবসায় আসার জন্য উত্সাহিত করতে চালু হয়েছে একাধিক প্রকল্প।
নারীর ক্ষমতায়নের একটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ মহিলাদের দেশের অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করা। আর তারই একটা অংশ হল মহিলাদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু করে আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে মহিলাদের ব্যবসার পথ খানিক সুগম করা। আসুন জেনে নিই সেরকমই কিছু প্রকল্প ও ঋণের কথা, যার সুবিধা পেতে পারেন মহিলা উদ্যোগপতি ও ছোট ব্যবসায়ীরা।
১. সেন্ট কল্যাণী প্রকল্প
ছোট ও মাঝারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এই প্রকল্পতে পাওয়া যায় ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ। নতুন ব্যবসা শুরু করতে চলেছেন বা ইতিমধ্যে থাকা ব্যবসা বাড়াতে চান, এই দুই ক্ষেত্রেই এই ঋণ পাওয়া যেতে পারে। সেন্ট কল্যাণী প্রকল্পের আওতায় ঋণ পেতে কোনও গ্যারান্টার বা কোল্যাটারালের প্রয়োজন নেই। নেই কোনও প্রসেসিং ফি-ও। দশ লক্ষ পর্যন্ত ঋণে সুদের সাধারণ হার হল মার্জিনাল কস্ট অফ ফান্ডস বেসড লেন্ডিং রেট (এমসিএলআর) + ০.২৫%। দশ লক্ষের ওপর ঋণে সুদের হার(এমসিএলআর) + ০.৫০%।
২. দেনা শক্তি প্রকল্প
কৃষি, উত্পাদন, খুচরো ব্যবসা বা এইধরণের অন্য কোনও ছোট ব্যবসার জন্য মহিলা উদ্যোগপতিদের এই ঋণ দেয় দেনা ব্যাঙ্ক।
ঋণ পাওয়া যায় ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। সুদের হার নির্ভর করে বাজারের ওপর। এই প্রকল্পে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয় ক্ষুদ্র-ঋণ বা মাইক্রো-ক্রেডিটের আওতায়।
৩. ট্রেড রিলেটেড অন্ত্রপ্র্যন্যরশিপ অ্যাসিসট্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ট্রেড) স্কিল ফর উইমেন
মহিলা সশক্তিকরণের উদ্দেশ্যে তৈরি কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পের আওতায় ঋণ দেওয়া, প্রশিক্ষণ দেওয়া ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এই তিনটি ক্ষেত্রে টাকা দেওয়া হয়।
সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা যেসব মহিলারা সাধারণভাবে ব্যাঙ্কের ঋণ পান না বা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি নিজেরা সম্পন্ন করতে পারেন না তাঁদের জন্যই বিশেষভাবে এই ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনুমোদিত এনজিও-এর মাধ্যমে এই ঋণের আবেদন করা যায়।
কৃষি ছাড়া অন্য ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত দরিদ্র মহিলারা এই প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারেন। ঋণের ৩০ শতাংশ দেবে কেন্দ্র সরকার ও বা ৭০ শতাংশ দেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান।
যেমন একটি এনজিও ৫০ জন মহিলার জন্য মাথা পিছু ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ চাইল। তাহলে মোট টাকা হয় ২৫ লক্ষ। এরপর এনজিও ঋণ গ্রহীতাদের প্রশিক্ষণ, এনজিও চালানো ইত্যাদি আনুষাঙ্গিক খরচ মিলে মোট ১৫ লক্ষ টাকা চাইল। তাহলে মোট অঙ্কটা দাঁড়াবে ৪০ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে ভারত সরকারে পক্ষ থেকে অনুদান দেওয়া হবে সর্বোচ্চ ১২ লক্ষ টাকা। বাকিটা দেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান।
৪. স্ত্রী শক্তি প্যাকেজ ফর উইমেন অন্ত্রপ্র্যন্যর
মহিলা উদ্যোগপতিদের জন্য স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এই প্রকল্পে সেই সব ছোট ব্যবসাই ঋণ পেতে পারে যার ৫০% এর বেশি শেয়ারের অধিকারী কোনও এক বা একাধিক মহিলা।
ঋণের পরিমাণ ২ লক্ষ টাকার বেশি হলে সুদের হারে ০.৫% ছাড়া পাওয়া যাবে। কুটীর শিল্পের জন্য ঋণ নিলে ৫ লক্ষ্য টাকা পর্যন্ত ঋণে কোনও সিকিউরিটির প্রয়োজন নেই।
৫. মূদ্রা যোজনা প্রকল্প
ছোট ব্যবসার জন্য কেন্দ্র সরকারের এই প্রকল্পে কিছু বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে মহিলা উদ্যোগপতিদের জন্য। সুদের হারে ছাড় সহ নানা ধরনের এই সুবিধা নির্ভর করে ঋণদাতা ব্যাঙ্ক বা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর।
যেসমস্ত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান মহিলা উদ্যোগপতিদের ঋণ প্রদান করে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের থেকে মূদ্রা যোজনার আওতায় ঋণ পাওয়া যায়। ঋণের পরিমাণ ৫০,০০০ টাকা থেকে ৫০ লক্ষ টাকা। ১০ লক্ষ টাকার ওপর ঋণ নিলে তবেই প্রয়োজন কোল্যাটারাল ও গ্যারান্টারের প্রয়োজন।
৬. সিন্ড মহিলা শক্তি
ব্যবসা শুরু করতে চলেছেন এবং ইতিমধ্যেই ব্যবসা করছেন এই দুধরনের মহিলা উদ্যোগপতিরাই সিন্ডিকেট ব্যাঙ্কের এই ঋণ পেতে পারেন। এই প্রকল্পের আওতায় নগদ ঋণ ও টার্ম ঋণ দুটোই পাওয়া যায়। মহিলা নেতৃত্বাধীন যেসব ব্যক্তি বা অংশীদারি কোম্পানির ৫০% এর বেশি আর্থিক শেয়ার অধিকারী মহিলারা সেই কোম্পানিই এই ঋণের জন্য আবেদন জানাতে পারে।
প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে যে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা ডিরেক্টরের পদে কোনও মহিলা রয়েছেন সেই কোম্পানি আবেদন জানানোর যোগ্য। এই প্রকল্পের আওতায় ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যেতে পারে।
৭. মহিলা উদ্যম নিধি প্রকল্প
কুটীর ও ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য মহিলা উদ্যোগপতিদের এই ঋণ দিয়ে থাকে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক। এছাড়া ব্যবসার প্রসার, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার বা নতুন পণ্য তৈরির জন্যও এই ঋণ নেওয়া যেতে পারে। এই প্রকল্পে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যায়। ঋণ শোধ করার সময়সীমা ১০ বছর। বিউটি পার্লার খোলা, ডে কেয়ার সেন্টার, অটো রিকশা কেনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা প্ল্যান রয়েছে।
৮. ইউনাইটেড মহিলা উদ্যোমী যোজনা
উত্পাদন ও বিভিন্ন পরিষেবা সঙ্গে যুক্ত ক্ষেত্রে ব্যবসার জন্য মহিলা উদ্যোগপতিদের এই ঋণ দেয় ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। মহিলা হস্তশিল্পী, তাঁতী, কুমোর, ছুতোররা এই ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন।
এছাড়াও দর্জির কাজ, বিউটি পার্লার, জেরক্স সেন্টার, টাইপিং সেন্টার, সাইবার ক্যাফে, গাড়ির যন্ত্রপাতি সারানো, লন্ড্রি, এসটিডি আইএসডি বুথ, কেবল টিভি নেটওয়ার্ক, বেবি ডে কেয়ার, মোবাইল সারানো, টিভি সারানো ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা বা সম্প্রসারণের জন্য এই ঋণ পাওয়া যেতে পারে।
খুচরো ব্যবসাতের এই প্রকল্প প্রযোজ্য নয়। কোম্পানির অন্তত ৫০ শতাংশ আর্থিক মালিকানা হতে হবে কোনও মহিলার। মোট ঋণের পরিমাণ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
৯. কানাড়া এমএসই ভিজেতা
মহিলা ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য কানাড়া ব্যাঙ্কের বিশেষ ঋণ প্রকল্প কানাড়া এমএসই ভিজেতা। ১০ লক্ষ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যেতে পারে। অংশীদারি ব্যবসার ক্ষেত্রে সংস্থার সিংহভাগ অংশীদারি হতে হবে মহিলার এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট মহিলা নিয়ন্ত্রনাধীন হতে হবে। খুচরো ব্যবসাসহ যেকোনও ছোট ও মাঝারি শিল্পে এই ঋণ পাওয়া যাবে।
এছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও মহিলা উদ্যোগপতিদের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যবসা শুরু করার জন্য নানা প্রকল্প রয়েছে। আপনার যদি কোনও ব্যবসার আইডিয়া থাকে যা মূলধনের অভাবে শুরু করতে পারছেন না তাহলে নিকটবর্তী ব্যাঙ্কে গিয়ে কথা বলুন। তারাই আপনার প্রয়োজনীয়তা ও যোগ্যতা অনুযায়ী আপনার জন্য উপযুক্ত প্রকল্পের সন্ধান দিতে পারবে।
এছাড়া আপনার যদি ইতিমধ্যে নিজের ছোট ব্যবসা থাকে তাহলেও আপনি এইসব প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারেন।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো + ইন্টারনেট