চাশতের নামাজের নিয়ম
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর জন্য বাধ্যতামূলক। তবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব ফরজ নামাজ ছাড়া কিছু সুন্নাত এবং নফল নামাজের কথা বলেছেন ।
হাদিস শরিফে আছে, বান্দার ফরজের ঘাটতি হলে তা সুন্নত ও নফল ইবাদত দিয়ে তা পূরণ করা হবে। তাই মুমিন বান্দারা ফরজ আমলের পাশাপাশি নফল আমল ও করে থাকেন ।
এরকম অন্যতম একটি নফল ইবাদত হচ্ছে চাশতের নামাজ। এ নামাজকে আরবিতে ‘সালাতুদ্দোহা’ বলা হয়। সালাতুদ দোহা (আরবি: صلاة الضحى) হল ফজর ও যোহরের নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে পড়ার জন্য নফল বা ঐচ্ছিক নামাজ।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে,
أوصاني خليلي بثلاث لا أدعهن حتى أموت : صوم ثلاثة أيام من كل شهر ، وصلاة الضحى ، ونوم على وتر . رواه البخاري
‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে তিনটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন – যা আমি মৃত্যু পর্যন্ত কখনো ছাড়বো না।
১. প্রতি মাসে তিন রোজা,
২. চাশতের নামাজ (সালাতুদ দুহা),
৩. এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিতর নামাজ আদায় করা।’ – (বুখারী, হাদিস : ১১২৪; মুসলিম, হাদিস : ৭২১)
চাশতের নামাজ মুমিনদের জন্য উপহার স্বরূপ। এটা আদায় করলে আল্লাহ বিপুল পুণ্য ও সওয়াব দেবেন।বুরাইদা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের শরীরে ৩৬০টি জোড় রয়েছে। অতএব মানুষের কর্তব্য হল প্রত্যেকটি জোড়ের জন্য একটি করে সদকা করা। ’
সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! কার শক্তি আছে এই কাজ করার? তিনি (সা.) বললেন, মসজিদে কোথাও কারো থুথু পড়ে থাকতে দেখলে তা ঢেকে দাও অথবা রাস্তায় কোনো ক্ষতিকারক কিছু দেখলে সরিয়ে দাও। তবে এমন কিছু না পেলে, চাশতের দুই রাকাত সালাতই এর জন্য যথেষ্ট। ’ (আবু দাউদ, হাদিস নং ৫২২২)
এই হাদিসটি মূলত চাশতের সালাত বা সালাতুদ্দোহা এর অপরিসীম গুরুত্ব ওমাহাত্ম্যের কথা তুলে ধরে। এর থেকে আরো বোঝা যায়, চাশতের নামাজ বা সালাতুদ্দুহার মাধ্যমে ৩৬০টি সদকার সমতুল্য সওয়াব পাওয়া যায়।
আয়েশা(রা:) ৮ রাকাত চাশতের সালাত আদায় করতেন আর বলতেন, যদি আমার মা-বাপকেও জীবিত করে দেওয়া হয় তবুও আমি তা ছাড়ব না (মালেক, মুয়াত্তা, মিশকাত ১৩১৯নং)। এই হাদিস দ্বারা চাশতের নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
চাশতের নামাজের সময়:
সকাল গড়িয়ে সূর্যের তাপ যখন প্রখর হতে শুরু করে ঠিক তখন থেকে এই নামাজ আদায় শুরু করা যায় ।এবং সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়া পর্যন্ত বাকি সময় থাকে।
আলেমগণ এর মতে দিনের এক চতুর্থাংশ অর্থাৎ, দিনের চার ভাগের একভাগ যখন পার হয়ে যায় তখন এই নামাজ আদায় করা উত্তম । অর্থাৎচাশতের নামাজ বা সালাতুদ্ দুহা আদায় করার উত্তম সময় হচ্ছে সূর্যোদয় এবং যোহর নামাযের মধ্যবর্তী সময়।সময়ের হিসাবে গ্রীষ্মকালে সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়। আর শীতকালে শুরু হয় সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে যোহরের সালাত এর আগ পর্যন্ত পড়া হয়।
চাশতের নামাজের রাকাত সংখ্যা:
চাশতের নামাজের সর্বনিম্ন ২ রাকাত পড়া আবশ্যক। এছাড়া ৪, ৮, ১২ রাকাত পর্যন্ত হাদীসে পাওয়া যায়।উম্মেহানী কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী(স:) মক্কা বিজয়ের দিন তার ঘরে চাশতের সময় ৮ রাকাত নামায পড়েছেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৩০৯ নং)। আয়েশা(রা:) বলেন, মহানবী(স:) ৪ রাকাত চাশতের নামায পড়তেন এবং আল্লাহর তাওফিক অনুসারে আরো বেশি পড়তেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আবু যর (রা.)-কে বলেছেন,
إن صليّت الضّحى ركعتين لم تُكتب من الغافلين، وإن صلّيتها أربعاً كُتِبتَ من المُحسنين، وإن صلّيتها ستّاً كُتِبتَ من القانتين، وإن صلّيتها ثمانياً كُتبتَ من الفائزين، وإن صلّيتها عشراً لم يُكتب عليك ذلك اليوم ذنب، وإن صلّيتها اثنتي عشرة ركعة بَنى الله لك بيتاً في الجنّة
‘তুমি যদি চাশতের নামাজ দুই রাকাত পড়ো, তাহলে তোমাকে গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। আর যদি চার রাকাত পড়ো, তাহলে তুমি নেককার মধ্যে গণ্য হবে। আর যদি আট রাকাত পড়ো, তবে সফলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। আর যদি দশ রাকাত পড়ো তাহলে কেয়ামত দিবসে তোমার কোনো গুনাহ থাকবে না। আর যদি বারো রাকাত পড়ো, তাহলে আল্লাহ তোমার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি তৈরি করবেন।’ (সুনানে কুবরা লিল-বাইহাকী, পৃষ্ঠা : ৩/৪৮)
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) এর বোন উম্মেহানি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন আমার ঘরে এসে দুপুরের পূর্বে চাশতের আট রাকাত নামাজ আদায় করেছেন। (বুখারি, হাদিস নং: ২০৭)
তবে সর্বনিম্ন দুই রাকাত পড়া আবশ্যক।
চাশতের নামাযের নিয়ম:
চাশতের নামাজ অন্য যেকোনো দুই রাকাত বিশিষ্ট সুন্নত বা নফল নামাজ আদায়ের মতই। কোনো নফল নামাজে যেমন দুই রাকাত পড়ে ডানে ও বামে সালাম ফিরিয়ে শেষ করা হয়, এখানেও ঠিক তেমনই। হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
صلاة الليل والنهار مثنى مثنى
‘দিন ও রাতের নফল নামাজ দুই দুই রাকাত করে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৫৯৭; আবু দাউদ, হাদিস : ১২৯৫)
অন্য হাদিসে আছে, তিনি সংক্ষিপ্তভাবে তা আদায় করেছেন। তবে সংক্ষিপ্তভাবে পড়লেও রুকু এবং সিজদায় তিনি পূর্ণ ধীরস্থিরতার সঙ্গে ছিলেন। প্রতি দুই রাকাত পরপর সালাম ফিরিয়ে ছিলেন।
চাশতের নামাজের ফজিলত:
চাশতের নামাজ সম্পর্কে হাদিসে অনেক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে।
হযরত আবু উমামা (রা) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “যে ব্যক্তি কোন ফরজ নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে স্বগৃহে থেকে অজু করে (মসজিদের দিকে) বের হয় সেই ব্যক্তির সওয়াব হয় ইহরাম বাঁধা হাজীর ন্যায়। আর যে ব্যক্তি কেবলমাত্র চাশতের নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে বের হয়, তার সওয়াব হয় ওমরা করার সমান। (আবু দাউদ, সুনান, সহিহ তারগিব ৩১৫ নং)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক যোদ্ধা বাহিনী প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধ সফরে তারা বহু যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভ করে খুব শীঘ্রই ফিরে আসে । লোকেরা তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটবর্তিতা, লব্ধ সম্পদের আধিক্য এবং ফিরে আসার শীঘ্রতা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করতে লাগল। তা শুনে আল্লাহর রাসুল বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে এদের চেয়ে নিকটতর যুদ্ধক্ষেত্র, ওদের চেয়ে অধিকতর লব্ধ সম্পদ এবং তাদের চেয়ে শীঘ্রতর ফিরে আসার কথার সন্ধান বলে দেব না? যে ব্যক্তি সকালে অজু করে চাশতের নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে যায় সে ব্যক্তি ওদের চেয়ে নিকটতর যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান করে, ওদের চেয়ে অধিকতর সম্পদ লাভ করে এবং ওদের চেয়ে অধিকতর শীঘ্র ঘরে ফিরে আসে।”(আহ্মদ, ত্বাবারানী, সহীহ তারগীব হাদিস নাম্বার ৬৬৩)
হযরত উক্ববাহ্ বিন আমের জুহানী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আল্লাহর রসূল বলেছেন, “আল্লাহ আয্যা অজাল্ল্ বলেন, ‘হে আদম সন্তান! দিনের প্রথমাংশে তুমি আমার জন্য চার রাকাত নামাজ পড়তে অক্ষম হয়ো না, আমি তার প্রতিদানে তোমার দিনের শেষ অংশের জন্য যথেষ্ট হব।” (আহমদ, আবু ইয়ালা, সহীহ তারগীব ৬৬৬ নং)
চাশতের নামাজ মুমিনদের জন্য উপহার স্বরূপ।চাশতের নামাজের এত ফজিলত থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ এই নামাজ না পড়ে তবে সে অধিক সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। এটা আদায় করলে আল্লাহ বিপুল পুণ্য ও সওয়াব দেবেন। আখেরাতে এর প্রতিদান দেবেন। তবে এই নামাজ না পড়লে কেউ গুনাহগার হবে না।