বিজয় দিবস
সূচনা
বিজয় মানে হচ্ছে কোন কিছুতে জয়লাভ করা। কোন কিছুতে জয়লাভ করতে গেলে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়। তারপরও মানুষ বিজয়ী কে ভালোবাসে। কোন মানুষই পরাধীন থাকতে চায় না। তারা চায় স্বাধীনভাবে বাঁচতে। পাখির মত ডানা মেলে উড়তে। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু স্বার্থপর জাতিগোষ্ঠী রয়েছে যারা অন্যদেরকে স্বাধীনতা দিতে চায় না। এই স্বাধীনতা কে জীবন দিয়ে অর্জন করে নিতে হয়। কখনো কখনো প্রয়োজন পড়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। এই যুদ্ধে আত্মদানের মাধ্যমে অর্জিত হয় বিজয়। আর এই বিজয় যেই দিন অর্জিত হয় প্রতিবছর এই দিনটিকে বিজয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।
বাংলাদেশের বিজয় দিবস
বাঙালি জাতিও একসময় পরাধীনতার শিকলে বন্দি ছিল। কিন্তু অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর স্বাধীনতা অর্জন করে। ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা। বিভিন্ন উপনিবেশিক শাসনের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে 26 বছর পরাধীন ছিল বাঙালি জাতি। কিন্তু দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে অবশেষে 16 ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। এই দিনটি আমাদের বিজয় দিবস।
বাংলাদেশের বিজয় দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি
প্রায় দুই শত বৎসর উপনিবেশিক শোষণ এরপর তীব্র আন্দোলনের মুখে 1947 সালে এই উপমহাদেশ ছেড়ে যেতে ইংরেজরা বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র এরপর ও থেকে যায় এই উপমহাদেশে। তারা আমাদেরকে বিভক্ত করা যায় জাতিগতভাবে। তাদের সময় যে দাঙ্গা আমাদের মনে স্থান করে নিয়েছিল তার থেকে বাঁচতে আমরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশ কে দুটি দেশের মধ্যে ভাগ করে নেই। একটি হচ্ছে ভারত। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়ে গঠিত হয় এই রাষ্ট্র।যার অবস্থান হচ্ছে মাঝখানে। পূর্ব এবং পশ্চিম অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। পশ্চিম অংশটির নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব অংশটির নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান।
- আরো পড়ুনঃ ছেলেদের ইসলামিক নাম অর্থসহ
কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনা লগ্ন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ বিভিন্নভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে শুরু করে। প্রথমেই শুরু করে তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এদেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা এর বদৌলতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। কিন্তু এদেশের মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করে। ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে পড়ে এবং তীব্র আন্দোলনের মধ্যে পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এতে বাঙালি জাতি এবং পাকিস্তানিদের মধ্যে একটা বিরাট মনোভাব সৃষ্টি হয় যা 1971 এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ হয়। 62 এর শিক্ষা আন্দোলন, ছয়ষট্টি এর ছয় দফা আন্দোলন এবং 69 এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ সৃষ্টির মূলে বড় অবদান রাখে। 70 এর নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে গরিয়সী শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে 7 ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।
সেই ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার বিষয়টি সমগ্র জাতির মধ্যে একটি চেতনা প্রতিষ্ঠা করে। 25 মার্চ কালো রাতে যখন পাকহানাদার বাহিনী এদেশের নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর আক্রমণ চালায় তখন 26 শে মার্চের প্রথম প্রহরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়। এবং সেই আহবানে সাড়া দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতির ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর। সমগ্র দেশকে 11 টি সেক্টরে বিভক্ত করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। এপ্রিল মাসের 10 তারিখ মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় যারা সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করে। ভারত 6 ডিসেম্বর বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এবং 16 ই ডিসেম্বর 93 হাজার পাক হানাদার সহ জেনারেল নিয়াজী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এবং পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
- আরো পড়ুনঃ সেরা পার্টটাইম চাকরি
বাঙালির বিজয় দিবসের উৎসব
16 ই ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর জাতীয় স্মৃতিসৌধ শ্রদ্ধা অর্পণের মাধ্যমে বিজয় দিবসের উৎসব শুরু হয়। এদিন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এদিন সারাদেশে সরকারি ছুটি পালিত হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত থেকে সেই কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন। সাথে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত থাকেন। বিজয় দিবস এর এই দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি অফিস-আদালত এবং সকল দোকানপাটে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা টানানো থাকে। দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। সারাদেশে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত এর জন্য দোয়া প্রার্থনা করা হয়। সমগ্র দেশে দিন বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়। দেশব্যাপী উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
বিজয় দিবসের চেতনা
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন,
সাবাস বাংলাদেশ !এ পৃথিবী-
অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির একটি জাতীয় চেতনার নাম। আর সেই চেতনাকে ধারণ করে বাঙালি জাতি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে নিজের সম্মান কে সবার উপরে প্রতিষ্ঠা করবে। একাত্তরের সংগ্রাম বাঙালি জাতিকে শিখিয়েছে কিভাবে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হয়। বিজয় দিবস আমাদের চেতনাকে নতুন করে জাগ্রত করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে। বিজয় দিবসের চেতনা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই বিজয় দিবসের চেতনা আমাদের অনুভূতিতে অন্য মাত্রা যোগ করে।
- আরো পড়ুনঃ চুলকানি দূর করার সহজ উপায়
বিজয় দিবসের তাৎপর্য
বিজয় দিবস শুধু একটি দিনই নয়। বিজয় দিবস আমাদের গৌরবময় বিজয় অর্জন করার একটি দিন। এই দিনে আমাদের নিজেদেরকে নিয়ে নতুন করে ভাবার আবেগ তৈরি করে। আমাদের জাতির যে ইতিহাস সেটা যেন সঠিক ভাবে সংরক্ষিত হয় এবং নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে তার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে একসঙ্গে। সমগ্র ইতিহাস কে সংরক্ষন করতে হবে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে উত্থাপন করতে হবে। তারা আমাদের বীর দের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে এবং তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করে।
বিজয় দিবসে আমাদের প্রত্যাশা
আমরা বিদেশী শক্তির হাত থেকে স্বাধীনতা পেলেও এখনো আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পায়নি। যাদের কারণে আমাদের দেশ আজ অচল অবস্থা। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনজীবনে এখনো পরিপূর্ণ নিরাপত্তা আসেনি। বিপুল সংখ্যক মানুষ আজ বেকার। তাদের কর্মসংস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ এখনো গড়ে তুলতে পারেনি। তাই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে হবে, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করতে হবে।
বিজয় দিবস এবং আমাদের প্রাপ্তি
বিজয় দিবস আমাদের অনেক প্রাপ্তি এনে দিয়েছে। আমরা অন্যের দেশের শোষণ এবং শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি এবং নিজের দেশকে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, পল্লী জনপদ বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাত এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে ও ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। তৈরি পোশাক, চামড়া শিল্প, হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির মাধ্যমে আমাদের দেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধা আমাদের দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছে। আমরা ধীরে ধীরে উন্নত বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
উপসংহার
বিজয় দিবস এক মহান আবেগের নাম। এই দিনটিতে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা, পেয়েছি পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি। এই দিনটি আমাদের বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছে। তাই প্রতিবছর বিশেষ আনন্দ-উদ্দীপনা মাধ্যমে এই দিনটিকে আমরা পালন করি। সবার মাঝে বিজয়ের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিয়ে পরাধীনতার গ্লানি ভুলে থাকি।