যাকাতের হিসাব । যাকাত প্রদানের খাত কয়টি । যাকাত দেওয়ার নিয়ম

যাকাতের হিসাব । যাকাত প্রদানের খাত কয়টি । যাকাত দেওয়ার নিয়ম

আজকের পোস্টে যাকাতের হিসাব যাকাত প্রদানের খাত কয়টি এবং যাকাত দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। যাকাত সম্পর্কে যাদের যা প্রশ্ন রয়েছে আশা করছি সব প্রশ্নের উত্তর এক পোস্টে পেয়ে যাবেন। ধনী মুসলিমের উপর যাকাত প্রদান করা ফরজ যাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাদের উপর যাকাত আদায় করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের মাঝে সম্পদের সমান ভাগ নিশ্চিত করার জন্য যাকাত প্রথার প্রচলন করেন। যাকাত আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে মুসলমান অথবা মানবজাতির জন্য নেয়ামত স্বরূপ পবিত্র প্রথা। 

যাকাত কাকে বলে? 

যাকাত একটা আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, পরিছন্নতা, বৃদ্ধি পাওয়া। ইসলামের মোট পাঁচটি মূল স্তম্ভ রয়েছে তার মধ্যে যাকাত অন্যতম। ইসলামিক পরিভাষায় মুসলমানদের মধ্যে যাদের নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাদের গরীব, দুঃখী, অসহায় মানুষের মাঝে সম্পদ বিলিয়ে দেওয়া কে যাকাত বলে। আল্লাহপাক মানুষের হাতে সম্পদ পঞ্জীভূত থাকুক সেটা পছন্দ করেন না সেজন্যই মূলত আল্লাহ পাক পবিত্র এই প্রথা মানবজাতির জন্য কল্যাণস্বরূপ দিয়েছেন। 

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ 

তোমরা নামায কায়েম কর, এবং যাকাত প্রদান কর। (সূরা মুযযামমিল, আয়াত ২০)

যাকাত হচ্ছে দরিদ্র মুসলমানদের অধিকার। যাকাতকে দরিদ্র মানুষের জন্য অনুগ্রহ ভাবলে ভুল হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেছেন- 

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ 

এবং তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে দরিদ্র ও বঞ্চিতের হক রয়েছে। (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ১৯)

যাকাত কাদের উপর ফরজ / বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়

যাকাত কাদের উপর ফরজ এ সম্পর্কে আমাদের মাঝে অনেক কৌতুহল রয়েছে। আবার অনেকে এমন রয়েছে কত টাকা থাকলে আমাকে যাকাত দিতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা নেই। জেনে রাখা ভালো সকলের উপর যাকাত ফরজ নয়। শুধুমাত্র ওই ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ যার আল্লাহ তা'আলা নির্দেশিত নির্দিষ্ট সম্পদ রয়েছে। কাদের উপর যাকাত ফরজ সেই সম্পর্কে নিচের সম্পূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হলো- 

মুসলমান হতে হবেঃ যে ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ তাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। কোন অমুসলিমের ওপর যাকাত ফরজ নয়। যদি নও মুসলমান হয়ে থাকে কোন ব্যক্তি সে ক্ষেত্রে যেদিন তিনি মুসলমান হয়েছেন সেদিন থেকে তার ওপর নেসব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া শর্তে যাকাত ফরজ হবে। পূর্বে অমুসলিম থাকা অবস্থায় তার উপর সেই সময়ের যাকাত আদায় করতে হবে না বা যাকাত দিতে হবে না। 

নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হতে হবেঃ  যদি কোন ব্যক্তির কাছে কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তলা রুপা কিংবা ওই সমমূল্যের অর্থ বা সম্পদ জমা থাকে তবে তাকে যাকাত দিতে হবে। 

নিসাব পরিমান সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে হবেঃ নিসাব পরিমাণ সম্পদ কোনো ব্যক্তির কাছে তার দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি, জামা-কাপড়, কৃষি সরঞ্জাম ইত্যাদি বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। 

ঋণগ্রস্ত হওয়া যাবে নাঃ যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ তার উপর যাকাত ফরজ নয়। কিন্তু ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি তার ঋণের টাকা পরিশোধ করার পর অথবা ঋণের সম্পদ পরিশোধ করার পর নিসাব পরিমান সম্পদ তার কাছে জমা থাকে তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে। 

নিসাব পরিমান সম্পদ এক বছর স্থায়ী থাকতে হবেঃ নিসাব পরিমাণ সম্পদ কোনো ব্যক্তির কাছে পূর্ণ এক বছর স্থায়ী থাকতে হবে। যে সম্পদ কোনো একজন ব্যক্তির কাছে পূর্ণ এক বছর জমা থাকবে না তার উপর যাকাত দেওয়ার বিধান নেই। 

জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবেঃ কোন পাগল অথবা বুদ্ধি জ্ঞানহীন ব্যক্তির ওপর যাকাত আদায় করার বিধান নেই অর্থাৎ তার উপর যাকাত ফরজ নয়। যিনি জ্ঞান সম্পন্ন, আকল আছে তার ওপরেই যাকাত ফরজ। 

বালেগ হতে হবেঃ অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বা বালেগ এর উপর যাকাত ফরজ নয়। 

বর্তমান সময়ে কত টাকা থাকলে যাকাত দিতে হবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে সোনা রুপার বর্তমান বাজারদরের উপর। সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রুপার বর্তমান বাজার দর যা হবে সেই বাজারদর অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে। তবে অনেক মুহাদ্দিসগণের মতে যদি কোন ব্যক্তির কাছে এক লক্ষ টাকা জমা থাকে যেটা অতিরিক্ত থাকা তাকে যাকাত দিতে হবে। তবে যে হারে মুদ্রাস্ফীতি চলছে সে অনুপাতে এখন এক হিসাব দিব কিন্তু ছয় মাস পর সেই হিসাব মিলবে না। তাই আল্লাহ তায়ালার বিধান অনুযায়ী স্বর্ণ এবং রুপার দাম বাজারদরের সাথে যাচাই করে যাকাতের টাকার পরিমান নির্ধারণ করতে হবে। 

কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ নয় 

১. ব্যক্তিগত জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উপর যাকাত ফরজ নয় যেমন- আসবাবপত্র, থালা-বাসন, হাড়ি-পাতিল, শোকেস, পড়ার টেবিল, বই ইত্যাদি। 

২. যদি কোন ব্যক্তি থাকার জন্য অথবা ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি নির্মাণ অথবা ক্রয় করা হয় তাহলে সেই জমি তে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হোক বা না হোক তার উপর যাকাত আসে না। তবে যদি কেউ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে জমি ক্রয় করে অথবা জমি বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে ক্রয় করে তাহলে তার উপর যাকাত আসবে। 

৩. যেকোনো কারখানায় উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত মেশিন যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র সেইসাথে ব্যবহৃত গাড়ি ও যানবাহন এর উপর যাকাত আসবেনা। কিন্তু উক্ত কারখানায় উৎপাদিত মালামাল ও ক্রয়কৃত কাঁচামালের উপর যাকাত আসবে। 

৪. যেকোনো ধরনের যানবাহন (রিক্সা, বেবি, টেক্সি, বাস, লঞ্চ, স্টিমার, ট্রাক) যদি উপার্জন করার উদ্দেশ্য ক্রয় করা হয় তাহলে তার ওপর যাকাত আসবে না। তবে যদি কেউ ব্যবসার উদ্দেশ্যে গাড়ি ক্রয় করে তাহলে তার ওপর যাকাত দিতে হবে। 

৫. যেসব পেশাজীবী লোকেদের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় তাদের পেশার ক্ষেত্রে সে সকল যন্ত্রপাতি অথবা আসবাবপত্র উপর যাকাত দিতে হবে না। যেমন:  কৃষকের ট্রাক্টর ইলেকট্রিশিয়ানদের ড্রিল মেশিন

৬. হীরা মনি মুক্তা ডায়মন্ড স্বর্ণ রুপা যদি কেউ ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করেন তাহলে তার উপর যাকাত দিতে হবে কিন্তু যদি কেউ হীরা মনি মুক্তা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ক্রয় করেন তাহলে তার উপর যাকাত দিতে হবে না। 

৭. নাবালেগ এবং যারা পাগল তাদের উপর যাকাত দেওয়ার বিধান নেই। 

যাকাত দেওয়ার নিয়ম । যাকাত হিসাব করার নিয়ম

১। যে সকল সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয় সেই সম্পদ হিসাব করে তার 40 ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে অর্থাৎ 2.5 শতাংশ। যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে নগদ টাকা অথবা নেসব পরিমাণ সম্পদ অথবা মেসাব পরিমাণ যেকোনো মূল্যবান বস্তু ক্রয় করে তা গরিব দুঃখের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। 

২। যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে সাধারণত চন্দ্র মাসের হিসাব করা হয়। একটা নির্দিষ্ট চন্দ্র মাস থেকে আরেকটা নির্দিষ্ট চন্দ্র মাস পর্যন্ত যদি কোন ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে ওই মাসেই। 

৩। যদি কোন ব্যক্তির কাছে মেসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকে তাহলে তো তাকে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে কিন্তু যদি কারো কাছে তামাম মিশ্রিত সোনা থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে কি করবে। এক্ষেত্রে বিধান হচ্ছে যদি তার কাছে সোনার সাথে মিশ্রিত তামার পরিমাণ বেশি হয় অর্থাৎ তামা সোনার তুলনায় বেশি তাহলে যাকাত দিতে হবে না কিন্তু যদি মিশ্রিত তামার পরিমাণ সোনার চেয়ে কম হয় তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে। 

৪। যদি যাকাত দাতা ঋণগ্রস্ত হন তাহলে ঋণ পরিশোধ করার পর নেসব পরিমাণ সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকলে তাকে সেই সম্পত্তির উপর যাকাত দিতে হবে। কিন্তু যদি ঋণ পরিশোধ করার পর নেসব পরিমাণ সম্পত্তি তার কাছে জমা না থাকে তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে না। 

৫। যদি কোন ব্যক্তি পাওনাদার হয়ে থাকেন অর্থাৎ কাউকে ঋণ দিয়েছেন এবং যদি সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আশা না থাকে তাহলে যাকাত দিতে হবে না কিন্তু যদি টাকা ফেরত পায় তাহলে বিগত বছরের সহ যাকাত দিতে হবে। 

৬। যদি যৌথ কারবারে ব্যবসা থাকে তাহলে যৌথ হিসাব নয় বরং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাগের অংশের যাকাত দিতে হবে। 

৭। যে সকল সোনা রুপা অলংকার হিসেবে স্ত্রীর মালিকানায় থাকে সেটাকে স্ত্রীর সম্পত্তি হিসেবে ধরা হবে আর যদি সেই অলংকারাদী শুধুমাত্র স্ত্রীকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তার প্রকৃত মালিক স্বামী তাহলে তার উপর যাকাত দিতে হবে। কিন্তু যদি সেটা তাকে সম্পূর্ণ মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তার তার মালিক স্ত্রী হবে। এভাবে করে আরো কিছু বিধান রয়েছে যেমন নিজের কন্যা সন্তানকে গহনা বানিয়ে দেওয়া এবং সেটা যদি থাকে একবারে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেটার মালিক সে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, কন্যা সন্তানের বিবাহ করানোর উদ্দেশ্যে নাবালেক অবস্থায় গহনা বানিয়ে রাখা হয় সে ক্ষেত্রে সেই অলংকারের মালিক সেই কন্যা। এছাড়া কন্যাদের বিবাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাংকে টাকা জমানো হলে সেটার মালিকও সে। তবে যদি নাবালিক ছেলের জন্য ব্যাংকে টাকা রাখা হয় তাহলে সেই টাকার মালিক অভিভাবক যতদিন না পর্যন্ত সেই নাবালেক ছেলে সেই সম্পত্তি তার নিজের কব্জায় না নিবে। 
৮। টোটাল সম্পত্তির হিসাব করে যা যাকাত আসবে তার চেয়ে বেশি যাকাত দেওয়া উত্তম। 
৯। 

শাহীন

আমি শাহীন । পেশায় একজন ব্যবসায়ী । পাশাপাশি অনলাইনে কাজ করতে পছন্দ করি। আশা করছি আমার শেয়ারকৃত তথ্য থেকে আপনারা উপকৃত হচ্ছেন আর তা হলেই আমার পরিশ্রম স্বার্থক।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Ads

Ads