মানসিক রোগের লক্ষণ
মানুষের বিভিন্ন প্রকার রোগ হয়ে থাকে। এবং এর রোগ গুলো যেকোনো সময় যে কোন বয়সে হতে পারে। তেমনি করে মানসিক রোগ যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। অন্য সব রোগের যেমন চিকিৎসা রয়েছে তেমনি করে মানসিক রোগের ও চিকিৎসা রয়েছে। কিন্তু অন্য সকল রোগ খুব সহজেই বোঝা যায় বা লক্ষণগুলো বুঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায়। কিন্তু মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলো সহজে বোঝা যায় না। যার ফলে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এর ফলে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যারা কিনা মানসিক রোগ যে এক ধরনের রোগ সে বিষয়ে অবগত নন। তাই এই সকল বিষয় মাথায় রেখে আমরা আজকে মানসিক রোগের লক্ষণ গুলো সম্পর্কে আলোচনা করব।
আমাদের আজকের আর্টিকেলের বিষয়টি হলো মানসিক রোগের লক্ষণ সম্পর্কে। শুরু করা যাক আমাদের আজকের আর্টিকেল মানসিক রোগের লক্ষণ সম্পর্কে।
মানসিক রোগের লক্ষণ জানার আগে আমাদের জানতে হবে আসলে মন জিনিসটা কি।
মন
সাধারণত মনের রোগই হলো মানসিক রোগ। মন বলতে হৃদপিণ্ড বা আত্মা বোঝায় না। ব্রেন বা মস্তিষ্ককে মন বলা হয় না। সাধারণত মস্তিষ্কের চিন্তা বা অনুধাবন করার প্রক্রিয়াকেই মন বলে। মানুষের চালিকাশক্তি হলো মন। মানুষের বিবেক বুদ্ধি ও কাজ কর্মের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে মন। আবেগ চিন্তা ইচ্ছা কল্পনা মনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। যখন কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় তখন সেই ব্যক্তির মন স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তার চলাফেরা কথাবার্তা সবকিছুতেই একটা অসংগতিপূর্ণ আচরণ থাকে। আর এই সকল আচরণকেই মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।
এখন আমরা জানার চেষ্টা করব মানসিক রোগটা আসলে কি।
মানসিক রোগ
মানসিক রোগ হলো মানসিক ব্যাধি বা এক প্রকার রোগ। মানসিক রোগ বা মনোরোগ বলতে বুঝি একজন ব্যক্তির মস্তিষ্কের রোগের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আচার-আচরণ জীবনযাপনে অস্বাভাবিকতাকেই বোঝায়। যা সরাসরি মস্তিষ্কের বিশেষ অঞ্চল বা ফাংশন গুলোর সাথে জড়িত। মানসিক রোগের সূচনা হয় তখন যখন জিনগত বা ব্যক্তিগত জীবনের কোন কার্যকলাপে মস্তিষ্ক যখন তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে তার স্বাভাবিক পারিবারিক সামাজিক পেশাগত জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া মানসিক রোগী তীব্র পরিমাণের মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে।
মানসিক রোগের লক্ষণ সমূহ জানার আগে আমাদের জানতে হবে মানসিক রোগ আসলে কত প্রকার ও কি কি।
মানসিক রোগের প্রকারভেদ
মানসিক রোগ সাধারণত দুই প্রকার। যথা
- নিউরোটিক
- সাইকোটিক
নিউরেটিক
সাধারণত নিউরোটিক রোগের মধ্যে আছে ডিপ্রেশন, হতাশা, বিষন্নতা, অ্যাংজাইটি, সুচিবাই, অনিদ্রা, অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি, এই সকল মানসিক রোগের লক্ষণসমূহ দেখলে আপনি খুব সহজেই বুঝতে পারবেন আপনি কোন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
সাইকোটিক
অনেক সময় দেখা যায় সাইকোটিক রোগীরা নিজেরাই ডাক্তার দেখান কিংবা নিজেরাই ওষুধ খান। সাধারণত সাইকোটিক রোগীরা মনে করেন তারা সুস্থ আছেন। এবং তারা মনে করেন তাদের আশেপাশের লোকেরা তাদের ভুল ভাবছে। সাইকটিক রোগীদের অনেক সময় তাদের বোঝানো মুশকিল হয়ে পড়ে। সাইকোটিক রোগের মধ্যে রয়েছে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, আর এই লক্ষণগুলো হলো গুরুতর মানসিক রোগের লক্ষণ, আর এই সাইকোটিক রোগ মাত্র এক শতাংশ রুগীর হয়ে থাকে।
এখন আমরা জানব মানসিক রোগের লক্ষণ গুলো সম্পর্কে।
মানসিক রোগের লক্ষণ
- নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেওয়া।
- দীর্ঘ সময় ধরে মন খারাপ থাকা, কোন কিছুতেই আনন্দ খুঁজে না পাওয়া।
- দৈনিন্দন কাজকর্মে অনীহা। দাঁত মাজা, গোসল করা ইত্যাদি ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তাই বিরক্ত বা অলসতা বোধ করা।
- অল্প কিছুতেই রেগে যাওয়া। রুক্ষ মেজাজ, বদমেজাজ দেখানো।
- পরিবারের সবাইকে সন্দেহ করা, পরিবারের বাহিরেও সবাইকে সন্দেহ করা।
- কাউকে হত্যা করার চেষ্টা করা। কোন মা যদি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় তখন সে তার সন্তানকে হত্যা করে ফেলতে পারে। এবং নিজেও আত্মহত্যা করার চেষ্টা করতে পারে। মানুষকে মেরে ফেলানোর হুমকি দেওয়া।
- অনেক সময় দেখা যায় একা একা কথা বলা বা বিড়বিড় করা। একা একা হাসা একা একা কান্না করা।
- বিভিন্ন ধরনের গায়েবী শব্দ সোনা।
- যেকোনো ধরনের সমস্যা হলেই নিজেকে দায়ী করা । এছাড়া সবকিছুতে নিজেকে দায়ী করার প্রবণতা।
- সব সময় ভয় পাওয়া, কিংবা সবসময় আতঙ্কিত থাকা।
- অনেক সময় দেখা যায় উগ্র আচরণ করে, তাদের চলাফেরায় অধিক চঞ্চলতা দেখা দেয়, অনেক সময় মারপিট কিংবা ভাঙচুর করে থাকে।
- বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে চলে যাওয়া, কিংবা তাদের এড়িয়ে চলা।
- অনেক সময় দেখা যায় অতিরিক্ত ঘুম হয়, আবার অনেক সময় দেখা যায় অতিরিক্ত কম ঘুম হয়।
- ওজন কমে যাওয়া কিংবা ওজন অধিক বেড়ে যাওয়া।
- খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনীহা কিংবা ক্ষুধা না লাগা।
- চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে সব সময় নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা করে।
- সামাজিক সম্পর্কগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া।
এখন আমরা জানবো মানসিক রোগগুলো আসলে কি কারনে হয়ে থাকে
মানসিক রোগের কারণ
মানসিক রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এর কারণগুলো অধিকাংশ সময় অস্পষ্ট থাকে। কিন্তু সাধারণত বলতে গেলে মানসিক রোগ তিন ধরনের কারণে হয়ে থাকে। যথা
- সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে
- মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে
- জেনেটিক বা বংশগত কারণে
সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণ
বেশিরভাগ মানসিক রোগ হয়ে থাকে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে। অনেক সময় দেখা যায় বাবা মার বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে সন্তানেরা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় দেখা যায় কোন কাছের মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ার কারণে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। কিছু কিছু সময় দেখা যায় স্বামী স্ত্রীর অমিল এর কারণে স্বামী বা স্ত্রী মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় দেখা যায় সন্তানের কারণেও অনেক বাবা মারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় দেখা যায় স্কুল কলেজে সহপাঠীদের সাথে বৈষম্যতার কারণেও অনেক সময় এই মানসিক রোগের সূত্রপাত হয়। কিছু কিছু সময় ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ার কারণেও মানসিক রোগ হয়ে থাকে। বৈষম্য দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের অভাবে মানসিক রোগ হয়ে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় কঠোর শৃঙ্খলতার কারণেও শিশুরা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। সাধারণত বলতে গেলে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে মানুষ সব থেকে বেশি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন
অনেক সময় দেখা যায় মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণেও অনেকে মানসিক সমস্যায়ক্রান্ত হয়। মানুষের ব্রেনে কিছু কেমিক্যাল অনিয়মিত থাকতে পারে যেটা চিন্তা এবং আচরণের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এ রোগের গবেষণায় আক্রান্ত মানুষের ব্রেনের কিছু অস্বাভাবিক গঠন লক্ষ্য করা যায়। ব্রেন ইমাজিং এবং ডোমোগ্রাফি পরীক্ষা করে রাসায়নিক পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা গুলোর উপর ভিত্তি করেই মানসিক রোগের ওষুধ প্রদান করা হয়।
জেনেটিক বা বংশগত কারণ
অনেক সময় দেখা যায় গর্ভবতী মায়ের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি হলে বা দুশ্চিন্তায় কাটলে অনাগত সন্তানের জন্মগত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এই রোগটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক না হয়ে মানসিক রোগ হয়ে থাকে। এছাড়া পরিবারের সদস্যদের কারো যদি মানসিক রোগ থাকে তাহলে এই মানসিক রোগের সমস্যা পরবর্তী প্রজন্মের হতে পারে।
মানসিক রোগীদের প্রতি সাধারণ মানুষের করণীয়
- মানসিক রোগীকে পাগল কিংবা অসম্মানজনক শব্দ বলা থেকে বিরত থাকা
- তাদের সামাজিকভাবে বর্জন না করা কিংবা তাদেরকে সমাজ থেকে দূরে না রাখা।
- যদি পরিবারের আপন জন কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে দূরে সরিয়ে দিবেন না। বরঞ্চ তার পাশে থেকে তাকে মানসিকভাবে শক্তি দিবেন দরকার পড়লে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন। কেননা মানসিক রোগ ও অন্য সকল রোগের মতোই।
আজকে আর্টিকেলে আমরা মানসিক রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত হবে আলোচনা করেছি। আমাদের আজকের আর্টিকেলের বিষয়টি ছিল মানসিক রোগের লক্ষণ সম্পর্কে। যেকোনো রোগ হলেই অবশ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন সেটা মানসিক হোক কিংবা শারীরিক। আপনাকে আমাদের আজকের মানসিক রোগের লক্ষণ আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য ধন্যবাদ।