ভূমিকাঃ
উৎসব বাঙালির প্রাণ। উৎসব পেলেই বাঙালি মাতােয়ারা হয়ে ওঠে। সে যে উৎসবই হােক না কেন ধনী, দারিদ্র, নির্বিশেষে সকল বাঙালি বাংলা নববর্ষ, ঈদ, পুজো, বিভিন্ন পারিবারিক-সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সব ধরনের উৎসবেই নিজেকে শামিল করে। উৎসবের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উৎসব আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। উৎসবে বাংলাদেশ বিচিত্র রুপে ফুটে ওঠে। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেনঃ
জননী, তােমার শুভ আহ্বান।
গিয়েছে নিখিল ভুবনে
নতুন ধানে হবে নবান্ন
তােমার ভবনে ভবনে।
উৎসব কী?
উৎসব হল আনন্দ প্রকাশ ও লাভের মাধ্যম, এক কথায় যাকে বলা যায় আনন্দানুষ্ঠান। অন্য কথায় , যে সাম্প্রদায়িক বা পারিবারিক সমাবেশ থেকে সুখ বা আনন্দ লাভ করা যায় তাকেই উৎসব বলে। আভিধানিক অর্থেও ‘উৎসব’ বলতে আনন্দময় অনুষ্ঠানকে বােঝায়। তবে সে আনন্দের রূপ-চেতনা সবসময় এক রকম হয় না। সেজন্য পারিবারিক আঙিনায় সীমিত এবং দশজনকে নিয়ে কৃত অনুষ্ঠানকেই উৎসব বলা হয়ে থাকে। ইংরেজি ফেস্টিভ্যাল’ কথার অর্থও উৎসব। তবে একটু ব্যাপক অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সমাজের দশজনের সঙ্গে এর সম্পর্ক। ব্যক্তি বা পরিবার সেখানে গৌণ, কখনাে বা অনুপস্থিত। উৎসব সেখানে নির্দিষ্ট ঋতু বা দিনের অনুষ্ঠানমালার সমাহার। মােটকথা বেশ বড় বা দেশব্যাপী সংঘটিত অনুষ্ঠানকে উৎসব বলা হয়ে থাকে।
প্রধানত সর্বসাধারণ বা বহুজনের জন্যে নির্দিষ্ট দিন, সময় বা ঋতুতে এক বা একাধিক স্থান কিংবা বিশেষ কোনাে সমাজে বা সম্প্রদায়ে অনুষ্ঠেয় আনন্দজনক ক্রিয়া-কর্মই উৎসব। বাংলাদেশের উৎসবের বিভিন্নতা রয়েছে। এ উৎসবগুলােকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যেমন—ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, পারিবারিক উৎসব, মনীষীদের স্মরণােৎসব ইত্যাদি। কালের বিবর্তনে এসব উৎসবের কোনােটির রূপ বদলায়, কোনােটি বিলুপ্ত হয়, আবার কোনােটি নতুন সৃষ্টি হয়। তবে সব উৎসবের মূলেই রয়েছে আনন্দ।
বাঙালির উৎসবঃ
যে জাতির উৎসব নেই, সে জাতির প্রাণও নেই, চলার শক্তিও নেই। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই বাঙালি উৎসব প্রিয়। বাঙালি যখন কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পত্তন করেছিল তখন থেকেই অদ্যাবধি তার জীবনে নবান্ন, পৌষ-পার্বণ, গাজন, গম্ভীরা, টুসু, ভাদু, চড়ক, মহরম, ঈদ, নববর্ষ, আউনি-বাউনি ইত্যাদি উৎসবগুলাে বাঙালি জাতির ভাব-কর্ম চেতনার মূর্ত প্রকাশক। উৎসব অনুসরণ করে আসে মেলা। তাই বাঙালির কাছে যে-কোনাে উৎসব মানেই হলাে মেলা। উৎসব আর মেলা হলাে বাঙালির কাছে সমার্থক।
বাংলাদেশের উৎসবের শ্রেণিবিভাগঃ
বাঙালি উৎসব প্রিয়। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদশের ঋতু। বাংলার ষড়ঋতুপৃথিবীর যেকোন সৌন্দর্য পিপাসু মনকে যেমন আকৃষ্ট করে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের উৎসবের বৈচিত্র্যটা মানুষের মনকে আন্দোলিত করে। ঐতিহ্য পরম্পরায় বাঙালির উৎসবগুলোকে কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলোঃ
- ক)ধর্মীয় উৎসব
- খ)সামাজিক উৎসব
- গ)সাংস্কৃতিক উৎসব।
প্রধানত সর্বসাধারণ বা বহুজনের জন্যে নির্দিষ্ট দিন, সময় বা ঋতুতে এক বা একাধিক স্থান কিংবা বিশেষ কোনাে সমাজে বা সম্প্রদায়ে অনুষ্ঠেয় আনন্দজনক ক্রিয়া-কর্মই উৎসব। বাংলাদেশের উৎসবের বিভিন্নতা রয়েছে। এ উৎসবগুলােকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যেমন—ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, পারিবারিক উৎসব, মনীষীদের স্মরণােৎসব ইত্যাদি। কালের বিবর্তনে এসব উৎসবের কোনােটির রূপ বদলায়, কোনােটি বিলুপ্ত হয়, আবার কোনােটি নতুন সৃষ্টি হয়। তবে সব উৎসবের মূলেই রয়েছে আ অদ্যাবধি তার জীবনে নবান্ন, পৌষ-পার্বণ, গাজন, গম্ভীরা, টুসু, ভাদু, চড়ক, মহরম, ঈদ, নববর্ষ, আউনি-বাসকলেই সেদিন একটু ভালাে পােশাক পরে। একটু ভালাে খাবারের আয়ােজন করে। পাড়া-পড়শিকে খাইয়ে তারা খুশি করে। ঈদের নামাজের জন্যে তারা ঈদগাহ ময়দানে যায়। এ ময়দানকে তখন মিলন-ময়দান বলে মনে হয়। নামাজ শেষে তারা কোলাকুলি করে। সকল ভেদাভেদ ভুলে যায়। ঈদ-উৎসবের মূল বাণী হচ্ছে মানুষে মানুষে ভালােবাসা, সকলের মাঝে একতা ও শান্তি। “ভােগে নয়, ত্যাগেই সুখ“ ঈদ এ কথা মনে করিয়ে দেয়। ঈদ শুধু উৎসব নয়, একটি গভীর অর্থ নিহিত আছে ঈদে। সকল বাঙালি মুসলমানকে এটা বুঝতে হবে। তবেই ঈদ-উৎসব সফল হবে।
ক)ধর্মীয় উৎসব ঈদঃ
মুসলমান সমাজের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে ঈদ। এ উৎসবে আনন্দ আছে, কল্যাণ আছে। বাংলাদেশে বেশ ঘটা করে ঈদ উৎসব পালিত হয়। বছরে দুবার ঈদ আসে। প্রথমে ঈদ-উল-ফিতর, পরে ঈদ-উল-আজহা। প্রথমটি দান করার উৎসব। দ্বিতীয়টি ত্যাগ করার উৎসব।
ঈদ-উল-ফিতরঃ চন্দ্র-বছরের একটি বিশেষ মাস হচ্ছে রমজান। রমজান মাসে মুসলমানগণ রােজা রাখে। রােজার আর এক নাম সিয়াম সাধনা। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদ-উল-ফিতর। একে রোজার ঈদও বলা হয়।
ঈদ-উল-আজহাঃ ঈদ-উল-আজহা হচ্ছে আত্মত্যাগের ঈদ। একে কুরবার্ণির ঈদও বলা হয়। জিলহজ মাসের দশ তারিখে পালিত হয় এ উৎসব। তবে ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে যে কুরবাণি করা হয় তা ওই চাঁদের এগারাে এবং বারাে তারিখেও করা যায়। উভয় ঈদই বাংলাদেশে বেশ আঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়।
সকলেই সেদিন একটু ভালাে পােশাক পরে। একটু ভালাে খাবারের আয়ােজন করে। পাড়া-পড়শিকে খাইয়ে তারা খুশি করে। ঈদের নামাজের জন্যে তারা ঈদগাহ ময়দানে যায়। এ ময়দানকে তখন মিলন-ময়দান বলে মনে হয়। নামাজ শেষে তারা কোলাকুলি করে। সকল ভেদাভেদ ভুলে যায়। ঈদ-উৎসবের মূল বাণী হচ্ছে মানুষে মানুষে ভালােবাসা, সকলের মাঝে একতা ও শান্তি। “ভােগে নয়, ত্যাগেই সুখ“ ঈদ এ কথা মনে করিয়ে দেয়। ঈদ শুধু উৎসব নয়, একটি গভীর অর্থ নিহিত আছে ঈদে। সকল বাঙালি মুসলমানকে এটা বুঝতে হবে। তবেই ঈদ-উৎসব সফল হবে।
মুহররমঃ
মুহররম আরবি মাসের প্রথম মাস। এ মাসটি মুসলমানদের নিকট অতি পবিত্র। কারবালার ময়দানে ইমাম হােসেনের শহীদ হবার ঘটনা খুবই শােকাবহ। মুহররম মাসের দশ তারিখে ইমাম হােসেন শহীদ হন। আর তাই প্রতি বছর মুহররম মাসের দশ তারিখে এ শােকাবহ ঘটনার কথা মনে করে মুসলমানগণ হােসেনের জন্যে শােক প্রকাশ করেন। ওই দিনকে ‘আশুরা’ বলে। ১ গভীর ভাবের আবেশে মুহররম উৎসব পালিত হয়।
শিয়া মুসলমানগণ হােসেনের মাজারের অনুকরণে তাজিয়া বানায়। এই তাজিয়া নিয়ে তারা মিছিল করে। মিছিলকারীরা তরবারি, ঢাল, তীর-ধনুক ইত্যাদি হাতে করে যুদ্ধের অভিনয় করে। বর্ষা, লাঠি ইত্যাদিও যুদ্ধে ব্যবহূত হয়। মিছিলকারীদের মুখে ‘হায় হােসেন, হায় হােসেন রব শােনা যায়। ঢাকায় মুহররমের এই মিছিল হােসেনি দালান থেকে বের করা হয়। এ ছাড়া মানিকগঞ্জের গড়পাড়া, কিশােরগঞ্জের অষ্টগ্রাম এবং সৈয়দপুরে মুহররম উৎসব পালিত হয়।
শবেবরাতঃ
বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের একটি বড় উৎসব হচ্ছে শবেবরাত। এ রজনীতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের আগামী বছরের ভাগ্য নিরূপণ করেন। সারা বছর ধরে কার ভাগ্যে কী ঘটবে, এ রাতে তা নির্ধারিত হয়। চন্দ্র-বছরের একটি মাস ‘শাবান’। এই শাবান চাঁদের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতই হচ্ছে শবেবরাত।২ এই রাতেই বাংলাদেশের মুসলমানেরা শবেবরাতের উৎসব পালন করে। এই পুণ্যরাতে নামাজই উৎসবের মূল বিষয়। এই উৎসবে তাই কোনাে আবেগ-উচ্ছাস নেই। আছে কেবল সাধনা।
দুর্গাপূজাঃ
দুর্গাপূজা হিন্দু সমাজের বড় ধর্মীয় উৎসব। একদিকে দুর্গাদেবীর পূজা, অপরদিকে সবার পরশে পবিত্র করা পর্ব। এ কারণেই এই পূজার নাম দুর্গোৎসব। এই উৎসবের মতাে হিন্দু সমাজের আর কোনাে উৎসবই এমন আঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় না। এ কারণে দুর্গাপূজাকে ‘কলির অশ্বমেধ’ বলা। ৩ দুর্গাপূজার একটি পৌরাণিক কাহিনি আছে। শাস্ত্রে আছে দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিলাে জীবকে দুর্গতি দেওয়া। সেই দুর্গমকে বধ করে যিনি জীবজগতকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন, তিনি ‘মা দুর্গা’। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা হয় শরৎকালে। বাসন্তী পূজার প্রচলনও আছে। তবে তা ব্যাপক নয়। অযােধ্যার রাজা ছিলেন দশরথ। তার পুত্র রামচন্দ্র। এই রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতাকে করেন লঙ্কার রাজা রাবণ।
তখন রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রামচন্দ দুর্গাপূজা করেন। ওই পূজা হয়েছিল শরৎকালে। এজন্য এ পূজার নাম শারদীয় দুর্গাপূজা।
চৈতপূজার উৎসব
চৈতপূজার উৎসব হিন্দু সমাজের একটি বড় অনুষ্ঠান। প্রতি বছর চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে এ উৎসব পালিত হয়। ওই সপ্তাহের প্রথম দিকে উৎসব শুরু হয়, চৈত্র সংক্রান্তির দিন শেষ হয়। এ উৎসবের অন্য নাম চড়কপূজার উৎসব।
রথযাত্রা
বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের আর একটি উৎসব রথযাত্রা। আষাঢ় মাসে এ উৎসব পালিত হয়। এ উৎসবের সাথে ‘যাত্রা’ কথাটি যােগ হয়েছে। যাত্রা বলতে সাধারণত ‘গমন’ বােঝায়। তবে এর বিশেষ অর্থ হচ্ছে পবিত্র তীর্থযাত্রার উৎসব। সে জন্যই বলা যায় রথযাত্রা, স্নানযাত্রা ইত্যাদি। রথযাত্রার দেবতা গমন করেন, ভক্তপূজারি তাঁর পিছু পিছু যান। জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায়ও তাই ঘটে। এই যাত্রা উৎসব জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা থেকে শুরু হয়। শেষ হয় উলটো রথে।
জন্মাষ্টমী
বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের আর একটি বিশেষ উৎসব জন্মাষ্টমী। বিভিন্ন এলাকায় বেশ ঘটা করে এ উৎসব পালিত হয়। বর্ণ-গােত্র নির্বিশেষে সকল হিন্দু এ উৎসবে ভক্তিতে, আনন্দে এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে।
জন্মাষ্টমী হচ্ছে শ্রবণ বা ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। শ্রীকৃষ্ণ জন্ম গ্রহণ করেন এই তিথিতে হিন্দুদের কাছে এই মাস তাই অতি পবিত্র। প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, এ মাসের ওই বিশেষ দিনের উপবাসেই সাত জনমের পাপ মাপ হয়। অন্যান্য পুণ্যদিবসে মান ও পূজা করলে যে ফল পাওয়া যায়, জন্মাষ্টমীর দিনে স্নান-পূজায় তার কোটি গুণ ফল মেলে।
বুদ্ধ-পূর্ণিমা
প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে আগত এক মহামানবকে কেন্দ্র করে বুদ্ধ-পূর্ণিমা উৎসব শুরু হয়। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজের এক অতি পবিত্র উৎসব। এটি মূলত বৈশাখি পূর্ণিমা। এ তিথিতে নেপালের কপিলাবস্তু ও দেবদহ রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থান লুম্বিনীর শালবনে বুদ্ধদেবের জন্ম হয়। ঠিক এমনি দিনে বুদ্ধ গয়ার বােধিবৃক্ষ-মূলে বুদ্ধদেব বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হন। এ পুণ্যতিথিতেই কুশীনগরে মল্লাদের শালবনে জমক শালবৃক্ষ-মূলে বুদ্ধদেব মহানির্বাণ লাভ করেন। এই দিনটি পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত ‘বৈশাখি পূর্ণিমা বা বুদ্ধ-পূর্ণিমা’। এটি বৌদ্ধ সমাজের খুবই গৌরবময় অনুষ্ঠান। এ উৎসবের মূল কথাই হচ্ছে বুদ্ধের বাণী-স্মরণ।
প্রবারণা ও কঠিন চীবর দানঃ
প্রবারণা ও কঠিন চীবর দান বৌদ্ধ সমাজের একটি বড় উৎসব। ‘প্রবারণা’ কথার অর্থ হচ্ছে বিশেষভাবে বারণ বা নিবারণ করা। বৌদ্ধ বিধানমতে প্রবারণার আসল অর্থ ত্রুটি বা নৈতিক স্খলন নির্দেশ করার জন্য অনুরােধ জানানাে। একজন শিষ্য নিজের দোষ দেখিয়ে দেবার জন্য অপরকে অনুরােধ করেন। তখন ওই অপর ব্যক্তি শিষ্যকে তার দোষ দেখিয়ে দেন। এটাই এ উৎসবের মূল তত্ত্ব। প্রবারণা উৎসব হয় শরৎকালে। শরতের মনােরম পরিবেশে বাঙালি বৌদ্ধদের ঘরে ঘরে এ উৎসবের সাড়া জাগে।
বড়দিনঃ
বাংলাদেশের আর একটি বিশেষ উৎসব বড়দিন। এর ইংরেজি নাম ক্রিসমাস। খ্রিস্টান সমাজের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব এটি। এ উৎসবের মূল বিষয় হচ্ছে খ্রিস্টের আবির্ভাব উপলক্ষে আনন্দভােগ। বড়দিন জিশুখ্রিস্টের জন্মদিন। পঁচিশে ডিসেম্বর তারিখে বড়দিন পালিত হয়। এ ছাড়াও বাংলাদেশে আরও অনেক ছােটখাট ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়।
খ)সামাজিক উৎসব
বাংলাদেশের সামাজিক উৎসবগুলাের মধ্যে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শহীদ দিবসকে বাংলাদেশে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে।
স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারি
২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে আনন্দ উৎসবে পরিণত করা হলেও একুশে ফেব্রুয়ারিকে শােক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৫২ সালের এ দিনে বাংলাভাষা তথা মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করে সালাম, বরকত, রফিক, সফিউর, জব্বারসহ বাংলার অনেক দামাল ছেলে জীবন দিয়েছে। এ দিনটিকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশে বইমেলা এবং নানা সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলা নববর্ষঃ
বাংলা নববর্ষ বাঙালিদের একটি প্রধান সামাজিক উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি হচ্ছে পয়লা বৈশাখ। পুরাে বছরের দুঃখ, বেদনা, নৈরাশ্য পেছনে ফেলে বছরের নতুন এ দিনটি আসে। আমাদের মন তখন খুশিতে ভরে যায়, আমরা মেতে উঠি। বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ উদযাপন এদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্য। এই দিনটি উদযাপনের মাধ্যমে আমরা আমাদের সেই প্রাচীনতম ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক প্রবাহকে বাঁচিয়ে রেখেছি। নতুনকে গ্রহণ করার, পুরাতনকে মুছে ফেলার ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষাও আমরা গ্রহণ করে থাকি নববর্ষ উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে। এ দিনটির। গুরুত্ব এখানেই। এ দিনে ‘হালখাতা’, ‘পুণ্যাহ’, ‘বৈশাখি মেলা’ ইত্যাদি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। হালখাতা বাংলাদেশের মানুষের একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন করে হিসাবের খাতা চালু করা হয়। মিষ্টিমুখের মধ্য দিয়ে শুভ নতুন দিন কামনা করা হয়। তবে পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান মেলা। সমগ্র বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ও বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ২০০ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের উৎসবাদির মধ্যে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে নববর্ষ শ্রেষ্ঠ উৎসব।
নবান্নঃ
নবান্ন আসলে শস্যের উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন হয়ে থাকে। তবে পৌষ পার্বণেও কোনাে কোনাে অঞ্চলে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। নবান্ন মূলত কৃষকের উৎসব।
পৌষ-পার্বণঃ
পৌষ-পার্বণ মূলত পিঠার উৎসব। এ উৎসব এখনাে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। এছাড়া পৌষ সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উড়ানাে উৎসব। একে সাকরাইন উৎসব বলা হয়। এ উৎসবটি পুরােনাে ঢাকাবাসীরা উদযাপন করে। এ ছাড়াও বিয়ে, বনভােজন ইত্যাদি সামাজিক উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
গ)সাংস্কৃতিক উৎসবঃ
একুশের বইমেলা, আলােচনা সভা, ঢাকা বইমেলা , প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ , ফেডারেশন কাপ ফুটবল লিগ প্রভৃতি বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসব। সংস্কৃতিমনা জনগণ এসব উৎসব থেকে জ্ঞান এবং আনন্দ—দুটোই লাভ করে থাকে। একুশের বইমেলা ও আলােচনা উৎসব বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমান্বয়ে সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই এ উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম।
পারিবারিক উৎসবঃ
নবজাতকের জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানাবিধ পারিবারিক উৎসব বর্তমান। এগুলাের মধ্যে খাৎনা, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ, নবান্ন, পৌষপার্বণ প্রভৃতি প্রধান। নবজাতকের নাম রাখার দিনেও পারিবারিক উৎসবের আয়ােজন করা হয়। অনেক পরিবারেই জন্মােৎসব পালন করা হয় অত্যন্ত আঁকজমকের সঙ্গে। এছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক উৎসবের প্রচলন লক্ষ করা যায়। এসব উৎসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের জীবনকে পূর্ণ করে তােলে।
মনীষীদের স্মরণােৎসবঃ
বাংলাদেশে প্রায়ই মনীষী স্মরণােৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মনীষী-স্মরণােৎসবের মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মীর মশাররফ হােসেন, মহাকবি কায়কোবাদ, ইসমাইল হােসেন সিরাজী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লিকবি জসীমউদ্দীন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান প্রধান। তাঁদের জন্ম, মৃত্যু এবং অবদান সম্পর্কে প্রতিবছরই আলােচনা ও স্মরণােৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। বছরব্যাপী তাঁর জন্ম। শতবার্ষিক উৎসব পালন করা হয়েছে। ২৫ বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মােৎসব পালন করা হয়। এছাড়া এ.কে.ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন। আহমদসহ বাংলাদেশের নেতাদের মৃত্যুদিন ও জন্মােৎসব অতি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। প্রতিবছর এসব জাতীয় নেতার স্মরণ করা হয় তাঁদের অবদানের জন্য।
বাংলাদেশের উৎসবের সামাজিক দিকঃ
বাঙালির সর্ববৃহৎ সার্বজনীন উৎসব হলাে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। এদিন বাঙালি নতুন সাজে বৈশাখকে বরণ করে। কোথাও কোথাও বৈশাখী মঙ্গল শােভাযাত্রা বের হয়। সে শােভাযাত্রায় থাকে নানারকমের পশুপাখির মুখােশ, ঘােড়ার গাড়ি, গরু ও মাহিষের গাড়ি, ঢােলবাদ্যসহ তা নগরের রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ছাড়াও প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরে নববর্ষ জাকজমকভাবে পালন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে বসে মেলা। এ মেলা কোথাও একদিন, কোথাও তিনদিন, কোথাও সাত দিনব্যাপী হয়ে থাকে। আগে নববর্ষের আসল রূপ খুঁজে পাওয়া যেত গ্রাম-বাংলার নববর্ষের মেলায়। নদীর ধারে বটের ঝুরির নিচে বসতো সে মেলা। সে মেলায় পাওয়া যেত হরেক রকমের সদাই-মিষ্টিমিঠাই, গুড়ের জিলাপি, রসগােল্লা, কদমা, খাজা, বাতাসা, মুড়ি-মুড়কি, তিলের নাড়ু, ঘুড়ি আরাে কত কী? এছাড়াও মেলায় পাওয়া যেত সাংসারিক সকল দ্রব্য-লাঙল, জোয়াল, মই, দা-বটি-খন্তা, কুড়াল। আরাে ছিল- মাটির পুতুল, কাঠের ঘােড়া, টিনের জাহাজ, কাপড়ের ও কাগজের পুতুল, পাখি, কত রকমের বাঁশি-
সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি
এক পয়সায় কিনেছে ও
তালপাতার এক বাঁশি।
ক্ষণিকা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যটি এখন নতুন করে শহুরে স্থান দখল করেছে। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলেই তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলাে ভাবগম্ভীর পরিবেশে সম্পূর্ণ করে থাকে। এ উৎসবগুলােতে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মীয় পােশাকে নিজেদের সাজিয়ে তােলে। প্রতিটি পরিবারে নানারকমের নানা স্বাদের রান্নার আয়ােজন হয়। একে অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ঘটে, কুশল বিনিময় হয়। এক সঙ্গে চলে ভােজন পর্ব। এভাবেই বাঙালির কাছে উৎসব এক নতুন বার্তা নিয়ে আসে।
সামাজিক জীবনে উৎসবের তাৎপর্য বা গুরুত্ব বা বৈশিষ্টঃ
সামাজিক জীবনে উৎসবের তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। উৎসব মানুষের এক সামাজিক চেতনার আনন্দমুখর অভিব্যক্তি। তার সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণ-প্রবাহ। উৎসবের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় জাতির আত্মপরিচয়। উৎসবই তার প্রকৃত দর্পণ। মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলদ্ধি করে, সেইদিন। উৎসবে থাকে না প্রাত্যহিকতার মালিন্য-স্পর্শ, থাকে না প্রতিদিনের সাংসারিক সুখ-দুঃখের ক্ষুব্ধ চিত্র। উৎসবের মধ্য দিয়েই আমরা সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি। উৎসবের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। বাঙালির প্রাণের আকৃতি। আছে তার জীবনবােধ। আনন্দমুখর এই উৎসবপ্রাঙ্গণই হল তার মিলন-কামনার অন্যতম প্রেক্ষাপট। উৎসব তার সৃজনশীল মনেরই উচ্ছলিত ভাববিগ্রহ। এখানে তার ‘বার মাসে তের পার্বণ’-এর সমারােহ। উৎসবপ্রাচুর্য প্রমাণ করে তার একদা আর্থিক সচ্ছলতা, স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণপ্রবাহ। সেদিন তার হাতে ছিল উদ্বৃত্ত অবকাশ-সময়। মনে ছিল সৃষ্টির বেদনাবিলাস। তাইতো কবি বলেছেন-
নিজন বিজন দিবসে
আজ উৎসবের ছটা
তাই প্রাণে লাগিয়ে দোলা
ওরে আয় সকলে যাই মেলায় ।
জাতীয় জীবনে উৎসবের গুরুত্বঃ
উৎসবের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় জাতির আত্মপরিচয়। উৎসবের মধ্যেই বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার জীবন-সাধনার সিদ্ধি। অনুভব করেছে, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী- কিন্তু উৎসবের দিন বৃহৎ- সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ- সেদিন। সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ উৎসব ব্যতীত মানুষে মানুষে মিলনের এত বড় তীর্থ আর কিছুতেই নেই। গ্রামে যখন উৎসব হয়, তখন সমগ্র গ্রাম আনন্দে ও পরম শুভবােধে একটি পরিবারের রূপ নেয়। দেশব্যাপী যখন উৎসব হয়, তখন সমগ্র দেশ ও জাতি বৈচিত্র্যের মধ্যেও এক অখণ্ড ঐক্যের অনুভূতিতে নিজের সার্থকতা যেন খুঁজে পায়। বাংলাদেশের সভ্যতার এটাই সমন্বয়ী প্রতিভা এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য।
প্রত্যেক জাতির জীবনে উৎসবের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের জনজীবনেও উৎসব একটি সজীব ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশকে জানতে হলে এর জনজীবনের সঠিক পরিচয় জানা দরকার। সে পরিচয়ের অনেকটা পাওয়া যায় বাংলাদেশের উৎসবে। আর তাই বাংলাদেশের উৎসবের উৎস, স্বরুপ ও ঠিকানা সম্পর্কে চুড়ান্ত খোঁজখবর অতি জরুরি। কেননা, এতে বাংলাদেশের জনজীবনের মৌলিক ঐক্যের সন্ধান মিলবে। সহজ কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের। পরিচয় রয়েছে উৎসবের মধ্যে। উৎসবে কেবল সমাজ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপাদান লুকিয়ে নেই, মানুষে মানুষে সম্পর্কের উত্তম দিকগুলােও এতে লুকিয়ে রয়েছে।
উপসংহারঃ
উৎসব মানুষকে সাংসারিক দুঃখ-কষ্ট থেকে সাময়িক মুক্তি দেয়। একটুক্ষণের জন্য হলেও মানুষ একঘেয়েমি অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করে উৎসবে এক নতুন জীবনের স্বাদ পায় – এজন্যই কবি বলেছে-
একদিন ঠিক মাটিতে হারাবো তুচ্ছ জীবন-নদী,
তার আগে সখী কোন ক্ষতি নেই উৎসব করি যদি।
বেদনাবিধুর জীবনে উৎসব এক নতুন প্রাণ ও নির্মল আনন্দ সঞ্চার করে। তাই উৎসবের শালীনতা ও পবিত্রতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই সচেতন এবং আন্তরিক হওয়া প্রয়ােজন। দলমত ভুলে গিয়ে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উৎসবকে করে তুলতে হবে ঐক্য ও মিলনের প্রতীক। তাহলেই বাংলাদেশের উৎসব আমাদের কাছে নির্মল আনন্দের উৎস এবং কল্যাণের দৃষ্টান্ত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত আমরাও বলতে চাই-
আমার আনন্দ সকলের আনন্দ হউক, আমার শুভ সকলের শুভ হউক, আমি যাহা পাই, তাহা পাঁচজনের
সহিত মিলিত হইয়া উপভােগ করি- এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ।