আধুনিক জীবনে কম্পিউটারের গুরুত্ব |
আধুনিক জীবনে কম্পিউটারের গুরুত্ব
ভূমিকা:
কম্পিউটার আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কার আবিষ্কার। এ যন্ত্রটিকে ঘিরে বিশ্বের বুকে এক নীরব প্রযুক্তি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এ বিপ্লবের ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশের বুকে। তাই এদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে কম্পিউটারকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য। যুগের চাহিদা অনুসারে এদেশে কম্পিউটার শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়েই কম্পিউটার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের যথেষ্ট সুযােগ তৈরি হয়েছে। প্রয়ােজনীয়তা ও বাস্তবতার আলােকে আমাদের কম্পিউটার শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হতে হবে। মানসম্পন্ন কম্পিউটার শিক্ষার প্রসার ছাড়া আমরা আজকের দিনে জাতীয় উন্নতির কথা চিন্তাও করতে পারি না।
কম্পিউটারের পরিচয়:
গ্রিক শব্দ ‘Compute’ থেকে ‘Computer’ শব্দের উৎপত্তি। যার আভিধানিক অর্থ- গণনাকারী বা হিসাবকারী যন্ত্র। উদ্ভাবনের শুরুতে কম্পিউটারকে গাণিতিক ও হিসাবমূলক কাজে ব্যবহার করা হতাে বলে এর নাম রাখা হয়েছে কম্পিউটার। কিন্তু বর্তমানে কম্পিউটার প্রায় সকল কাজেই পারদর্শী। এ যন্ত্র মানুষের দেওয়া যৌক্তিক উপাত্তের ভিত্তিতে অতি দ্রুত সঠিকভাবে কোনাে কার্য সম্পাদন করতে পারে এবং নির্ভুল ফলাফল প্রদান করতে পারে।
কম্পিউটার আবিষ্কার ও বিবর্তন:
কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি নতুন আবিষ্কার হলেও এর পিছনে দীর্ঘদিনের ইতিহাস রয়েছে। বহুকাল ধরে বহুজনের অবদানের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে কম্পিউটার। যােগ-বিয়ােগ করতে পারে এমন একটি গণকযন্ত্র প্রথম আবিষ্কার করেন ক্লেইলি প্যাসকেল ১৬৪২ সালে। এর কিছুকাল পরে ১৬৭১ সালে গড ফ্রাইডে সর্বপ্রথম গুণ ও ভাগ করতে পারে এমন যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। এভাবে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কম্পিউটার ব্রিটিশ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজের হাতে এসে আধুনিক রূপ লাভ করে। তাই চার্লস ব্যাবেজকে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম ১৮৩৩ সালে পাঁচটি অংশে সম্পূর্ণ আধুনিক কম্পিউটারের গঠনতত্ত্ব আবিষ্কার করেন।
কম্পিউটারের প্রজন্ম:
বর্তমানে নানা ধরনের কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয়েছে। গঠনপ্রণালীর এক একটি বিশিষ্ট ধারাকে বলা হয় এক একটি প্রজন্ম। প্রথম পূর্ণাঙ্গা কম্পিউটার এনিয়াক থেকেই কম্পিউটার প্রজন্ম শুরু হয়। ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি ইউনিভ্যাক-১, আইসিএস-২৯০০, আইবিএম-৬৪০, সিস্টেম – ৩৬০, এডস্যাক – ৪৩০০ সিরিজের মেইনফ্রেম মডেল।
জেনারেশন কম্পিউটার: কম্পিউটার কোনও ব্যক্তিবিশেষের আবিষ্কার নয়। বিগত দেড়শাে বছর ধরে বহু মানুষের অসংখ্য আবিষ্কার ও ভাবনা-চিন্তার ফলশ্রুতি এতে আছে। এদের মধ্যে সর্বাগ্রে স্মরণীয় চার্লস ব্যাবেজের নাম। তিনি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের ক্যামব্রীজে একটি অটোমেটিক-মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটার গড়ার জন্যে সচেষ্ট হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চেপে চাপ দেওয়া বা ছিদ্র করার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাদি’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে চালু হয়।
সেকেন্ড জেনারেশন কম্পিউটার: সেকেণ্ড জেনারেশন কম্পিউটার-এ ট্রানজিস্টার স্থান পেল, এদের সারকিট হল ফার্স্ট জেনারেশন -এর তুলনায় অনেক ছােট। এদের পরিচালনা করতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তি দরকার হল । সর্বোপরি, এদের কাছ থেকে অতি দ্রুত কাজ পাওয়া গেল এবং এরা হয়ে উঠল বিশেষ নির্ভরযােগ্য। সেকেণ্ড জেনারেশন কম্পিউটার এর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা করে আই বি এম ১৪০১।
থার্ড জেনারেশন কম্পিউটার: থার্ড জেনারেশন কম্পিউটার-এ রয়েছে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) । এরা দামের দিক থেকে সস্তা এবং এছাড়া নির্ভরযােগ্যতার দিক থেকেও সেকেণ্ড জেনারেশনকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক দূর । দ্রুত কাজ করার ক্ষেত্রে এবং ব্যাপক ক্ষমতা নিয়ে কাজে লাগাবার ব্যাপারে এরা পূর্ববর্তী যুগের কম্পিউটারদের তুলনায় আরও অনেক উন্নত।
ফোর্থ জেনারেশন কম্পিউটার: এর প্রয়ােগ দেখা গেল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে। নতুন যুগের উন্নত ধরনের ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের সহায়তায় এদেরকে আগের যুগের কম্পিউটারদের তুলনায় আরও দ্রুত এবং আরও ছােট করে তৈরি করা সম্ভবপর হল।
ফিফথ জেনারেশন কম্পিউটার: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর ভিত্তি করে ফিফথ জেনারেশন বা পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার প্রযুক্তি যা নির্মাণের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হ ল কণ্ঠস্বর সনাক্তকরণ ও বিশ্বের সকল ভাষা বুঝতে পারা । একসাথে একাধিক প্রোগ্রাম বাধাহীনভাবে চলতে পারে।
মাইক্রো কম্পিউটার: মাইক্রো কম্পিউটার আকারে ছােট। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এদের প্রয়ােগ চলে। এ শ্রেণীর কম্পিউটারের সবচেয়ে বড় সুবিধা, খুবই স্বল্প ব্যয়ে এদের সংগ্রহ করা সম্ভব হল । ফলে এদের ব্যবহার বেড়ে চলে অতি দ্রুত গতিতে। কলকারখানায় অটোমেশিনের ক্ষেত্রে মাইক্রো কম্পিউটার বহুল পরিমাণে কাজে লাগতে দেখা গেল । এ ছাড়া,এরা ওজনে হালকা হওয়ায় খুব সহজেই এদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল।
কম্পিউটার ও তার কার্যকারিতা:
কম্পিউটার আসলে এক ধরনের যন্ত্র মস্তিস্ক। কম্পিউটারের থাকে তিনটি সুস্পস্ট অংশ– এক : সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট, দুই : ইনপুট, তিন ; আউটপুট। যে কোনো সমস্যা সংক্রান্ত সবরকম তথ্য নিয়ে কাজ করে সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট। ইনপুট তথ্য সংবলিত নির্দেশ প্রদান করে আর আউটপুট প্রকাশ করে গণনা সংবলিত ফল। যে যাবতীয় তথ্য নিয়ে কম্পিউটার কাজ করে, তাকে বলে প্রােগ্রাম। কম্পিউটারে তথ্য ও নির্দেশ প্রদানের জন্যে যে বিশেষ ভাষা ব্যবহার করা হয়, তাকে বলে প্রােগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ। আর এসব কিছুকে একত্রে অভিহিত করা হয় কম্পিউটার সফটওয়্যার বলে। এছাড়া কম্পিউটারের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণকারী একটা কাঠামাে থাকে, তাকে বলে হার্ডওয়্যার।
কম্পিউটারের বড় উপযােগিতা হল তথ্য ও প্রােগ্রামের রদবদল বা সংযােজন ঘটিয়ে একই কম্পিউটারকে দিয়ে নানা রকম কাজ করা। কম্পিউটার যে আজকের দিনে বিস্ময়কর ও বিশ্বস্তভাবে সবধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তার মূলে রয়েছে এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমনঃ
- ১)অত্যন্ত দ্রুত গণনার ক্ষমতা
- ২)বিপুল পরিমাণ উপাত্তকে সুসংবদ্ধভাবে যন্ত্র মগজে ধরে রাখার ক্ষমতা
- ৩)তথ্য বিশ্লেষণের নির্ভুল ক্ষমতা
- ৪)ডাটা ও প্রােগাম অনুসারে কাজ করার ক্ষমতা
বাংলাদেশে কম্পিউটার:
বাংলাদেশে কম্পিউটারের পদযাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে আণবিক শক্তি কমিশনে IBM – 1620 সিরিজের একটি কম্পিউটার আমদানির মাধ্যমে। আশির দশক পর্যন্ত এদেশে কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষার কোনাে সুযােগ ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে এদেশে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম্পিউটার শিক্ষা শুরু হয়। বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে কম্পিউটারের আগমন আমাদের দেশে ঘটলেও বর্তমানে তা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক কম্পিউটার শিক্ষার সূত্রপাত হয় ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে । উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৯৯১ সালে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৯৯৪ সাল থেকে কম্পিউটার শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
কম্পিউটার ও আধুনিক জীবন:
কম্পিউটার আধুনিক যুগে মানুষের পরম নির্ভরশীল বন্ধ। কোটি কোটি সংখ্যার অঙ্ক মিলিয়ে কর্তপক্ষের হাতে অতি অল্প সময়ে তুলে দিয়ে ক্যাশিয়ারকে নিশ্চিত নির্ভাবনায় ঘরমুখাে করিয়ে দিতে পারে, কম্পিউটার এখন বড় বড় কল-কারখানায় বসে উৎপাদনের পরিকল্পনা আর তা নিয়ন্ত্রণের খবরদারি করছে, লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করছে। রেলওয়ে, এয়ারলাইন্স, ব্যাংক রিসার্চ সেন্টার, ইনসিওরেন্স প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারের একচ্ছত্র আধিপত্য। পরীক্ষার ফল প্রকাশ, অপরাধীকে খুঁজে বের করা, পুরােনাে মামলার নথিপত্র খুঁজে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া, বিজ্ঞাপন প্রচার করা এ সমস্তই এখন করছে মানুষের সৃষ্ট ঐ যন্ত্র-মগজ।
কম্পিউটার চালিত ‘স্ক্যারার’ খুঁজে এনেছিল আটলান্টিক মহাসাগরে ভেঙে পড়া বিমানের ব্ল্যাকবক্স। যে সব দুরূহ কাজ মানুষের অসাধ্য, যে সব দুর্গম স্থান মানুষের অগম্য সেখানেই কম্পিউটারের প্রয়ােগ, আর সেখানে তার অকল্পনীয় সাফল্য। সে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও কম্পিউটার নিয়েছে শিক্ষকের ভূমিকা। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবই শেখাচ্ছে নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে। দাবা, ক্রিকেট, ফুটবলসহ নানারকম ভিডিও গেম খেলছে কম্পিউটার। এসব খেলায় কম্পিউটার মানুষের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় অংশ নিচ্ছে। মুদ্রণ জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে কম্পিউটার ।
ইন্টারনেটের সাহায্যে ঘরে বসে মুহূর্তেই বিশ্বের যে কোনাে জায়গায় যে কোন তথ্য আদান-প্রদান করা যাচ্ছে। আধুনিক জীবনে কম্পিউটার তাই অপরিহার্য। একই কারণে সভ্যতায় কম্পিউটারের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশেও কম্পিউটারের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এদেশে এখন মূলত মুদ্রণ শিল্প, ব্যাংক-অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে।
আধুনিক জীবনে কম্পিউটারের ব্যবহার:
কম্পিউটার ও বিজ্ঞান এক সূত্রে গাথা। একে অন্যের পরিপূরক। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে তাল মিলিয়ে কম্পিউটারের কর্মদক্ষতা বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে কম্পিউটারের ব্যবহার। আধুনিক জীবনে এমন কোন শাখা নেই যে যেখানে কম্পিউটারের ব্যবহার। নিচে কম্পিউটারের কয়েকটি ব্যবহার উল্লেখ করা হল।
ব্যবসায়ক্ষেত্রে কম্পিউটার:
বর্তমানে প্রায় প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। হিসাব রাখা, কর্মীদের হিসাব, আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি, পণ্যের হিসাব রাখা সহ আরও অনেক কাজে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহার করা হচ্ছে। কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার করে কর্মীদের সাথে এমনকি দেশের বাহিরে ব্যবসায়িকদের সাথে ই-মেইলের মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ ও ফাইল আদান-প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটার:
আমাদের জীবনে প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ের ন্যায় জাতীয় মেরুদন্ড শিক্ষাক্ষেত্রেও কম্পিউটারের অবাদ বিচরণ। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ডিজিটাল মাধ্যমে ঘরে বসেই পাঠদান চলছে। শুধু তাই নয় শিক্ষাক্ষেত্রে আরও নানাভাবে কম্পিউটার ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমনঃ
শিক্ষাদান: কোনাে কাহিনি পড়া বা শােনার চেয়ে ঐ কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা বা চলচ্চিত্র মানুষের মনে অনেক বেশি রেখাপাত করে। কম্পিউটারের সাহায্যে শিক্ষাদান বা গ্রহণের ক্ষেত্রে এর সবকটি সুযােগ কাজে লাগানাে যায়। নিচের ক্লাসে বর্ণ পরিচয়, গল্প, ইতিহাস ইত্যাদি কার্টুনের মাধ্যমে তুলে ধরলে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের কাছে তা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়। ওপরের ক্লাসেও বিজ্ঞান, ভূগােল, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়গুলাে রঙিন চিত্রে তুলে ধরে পাঠদান করা যায়। প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতির চেয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষাদান যে অধিক কার্যকর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্য সংরক্ষণ: তথ্য সংরক্ষণের এক সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ ভান্ডার হচ্ছে কম্পিউটার। কম্পিউটারে যেকোনাে তথ্য নিরাপদে সংরক্ষণ করা যায় । চাহিবামাত্র যেকোনাে তথ্য উদ্ধারে সক্ষম কম্পিউটারে উপাত্তগুলাে ইচ্ছামাফিক সাজিয়ে রাখা যায়। কম্পিউটারের স্মৃতিতে গােপনীয়তার সাথে সংরক্ষিত যেকোনাে তথ্যের নিরাপত্তার পূর্ণ নিশ্চয়তা থাকে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা কারণে কম্পিউটার দিনদিন তথ্য সংরক্ষণের অভিনব পন্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে ক্রমেই বেড়ে চলছে এর উপযােগিতা।
যােগাযােগ: কম্পিউটারের বিস্ময়কর সাফল্যে বিশ্ব আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। ফলে কম্পিউটার যােগাযােগ ক্ষেত্রে এ অভিনব বিপ্লব সাধন করেছে। কম্পিউটারের মাধ্যমে কোনাে শিক্ষার্থী অন্য কোনাে শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা বিশ্বের কোন অত্যাধুনিক লাইব্রেরির সাথে অনায়াসেই যােগাযােগ স্থাপন করতে পারছে। ফলে সে ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছে প্রত্যাশিত তথ্য বা সংবাদ। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফিচার অনায়াসেই একজন শিক্ষার্থী কাজে লাগাতে পারে কম্পিউটারের কল্যাণে।
পরীক্ষার ফলাফল তৈরি ও মূল্যায়ন:
বর্তমানে দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলাে পুরােপুরি কম্পিউটারনির্ভর। পরীক্ষার খাতা দেখা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ করার সমুদয় গুরুদায়িত্ব কম্পিউটারের। এক্ষেত্রে কম্পিউটারের কর্মপদ্ধতির প্রতি আস্থা রেখেই দেশে চালু হয়েছে ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গ্রেডিং পদ্ধতি। আর এ জটিল কাজটি সম্পাদন কম্পিউটার ছাড়া কল্পনাই করা যায় না।
উচ্চ শিক্ষায় কম্পিউটার:
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যল কলেজ এবং বুয়েটসহ বিশ্বের অনেক দেশেই আজ উচ্চশিক্ষায় কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে।
সংবাদ প্রচার ও প্রকাশনায়:
শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত সংবাদ প্রচার ও প্রকাশে কম্পিউটারের অবদান অনস্বীকার্য। টিভির প্রতিদিনকার সচিত্র সংবাদ পরিবেশনে এবং সংবাদপত্রের প্রকাশনায় কম্পিউটার আজ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবায় কম্পিউটার:
কম্পিউটার আবিস্কারের ফলে স্বাস্থ্যসেবায় বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। মেডিকেলে রোগীদের তথ্য সংরক্ষণ এবং রোগ নির্ণয়ের কঠিন কাজ সহজেই কম্পিউটারের মাধ্যমে করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ল্যাব সরঞ্জাম, হার্ট রেট মনিটর, এবং রক্তচাপ মনিটর এবং সর্বোপরি রোগীকে নিবির পর্যবেক্ষণে রাখার কাজটি কম্পিউটার খুব নির্ভুলতার সাথে করতে পারে।
সরকারী সেবায় কম্পিউটার:
বিভিন্ন সরকারী বিভাগ তাদের পরিষেবার মান এবং দক্ষতা উন্নত করতে কম্পিউটার ব্যবহার করে। উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে শহর পরিকল্পনা, আইন প্রয়োগকারী, ট্রাফিক এবং পর্যটন। কম্পিউটার তথ্য সংরক্ষণ, পরিষেবা প্রচার, অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক যোগাযোগের পাশাপাশি নিয়মিত প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে কম্পিউটার ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রচারণায় কম্পিউটার:
কম্পিউটার জটিল ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিপনন প্রচারনাকে আরও ফলপ্রসূ করতে সাহায্য করে। ফলে অল্প সময়ে নির্দিষ্ট গ্রাহকদের কাছে পণ্যের প্রচারণাসহ অনলাইন চ্যাটের মাধ্যমে গ্রাহকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে।
বিজ্ঞানশাস্ত্রে কম্পিউটার:
কাজের ক্ষেত্রে কম্পিউটারকে ব্যবহার করা দলে মধ্যে প্রথম সারির দল হল একজন বিজ্ঞানী। গবেষণার জন্য , স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের সাথে তথ্য ভাগ করে নেওয়ার পাশাপাশি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, শ্রেণীকরণ, বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণের জন্য কম্পিউটারকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় কম্পিউটার:
স্কাইপ এবং জুমের মতো সফ্টওয়্যার এবং ভিডিও কনফারেন্সিং পরিষেবাগুলির জন্য কম্পিউটার ইন্টারনেটের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম যোগাযোগ সহজ করে তুলেছে। পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের সাথে ভিডিও কলে যুক্ত হতে পারে। ব্যবসায়িক অংশীদাররা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মিটিং করতে পারে।
যাতায়াত ব্যবস্থায় কম্পিউটার:
রাস্তার যানবাহন, ট্রেন, প্লেন এবং নৌযানকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ও নিরাপদে চালানোর জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
কম্পিউটার ও বেকারত্ব:
বিজ্ঞানীদের চেষ্টার ফল এই যন্ত্রদানবের ক্ষমতা অপরিসীম। তাঁদেরই আশঙ্কা মানুষের সৃষ্ট এই যন্ত্রদানবকে দিয়ে কাজ করাতে করাতে এমন এক সময় আসবে, যখন কাজের ক্ষুধায় উন্মত্ত দানব তার স্রষ্টা মানুষকেই করবে ক্রীতদাস। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে দেখলেই সত্যটা স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। কম্পিউটারের ব্যাপক প্রয়ােগ ও ব্যবহার মানুষকে করবে সাময়িক কর্মহীন। তখন মানুষের ক্রীড়নক না হয়ে মানুষ হবে যন্ত্রের ক্রীড়নক। কম্পিউটার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিবে অনেক কাজ। কম্পিউটারের ব্যবহারে ইতােমধ্যে অফিসে, শিল্প প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন সংস্থায় কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযােগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। অবশ্য অপরদিকে কম্পিউটার বহু নতুন নতুন কর্মও সৃষ্টি করছে। অপারেটর, প্রােগ্রামার, হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পদে বহু লােকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। এইভাবে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কম্পিউটার সাময়িকভাবে কর্মশূন্যতা সৃষ্টি করলেও সামগ্রিকভাবে এটি বহুল কর্মসংস্থানের সুযােগও সৃষ্টি করবে।
কম্পিউটার ব্যবহারের বিরুপ প্রতিক্রিয়া:
কম্পিউটার আবিষ্কার এবং ব্যবহারে আধুনিক বিশ্ব তথা মানব সমাজে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা যায়। যুদ্ধ-বিগ্রহ, অস্ত্র নির্মাণ, আকাশ দখলের প্রতিযােগিতা প্রভৃতির পেছনে কম্পিউটারের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এছাড়া কম্পিউটারের মাধ্যমে সৃষ্ট ইন্টারনেট, ভিডিও গেম প্রভৃতির মাধ্যমে নানা কুরুচিপূর্ণ বিনােদন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। কম্পিউটার অনেক সময় মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তােলে। তাছাড়া দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মাত্রাতিরিক্ত কম্পিউটার ব্যবহারে চোখের ক্ষতি হতে পারে, মাথা ব্যথাসহ অন্যান্য শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
উপসংহার:
কম্পিউটারের বিস্তৃত কর্মকাণ্ড নিয়েই আজকের জগৎ। আজ আর কল্পনা করতে বাধা নেই যে, আগামী দিনে কম্পিউটার হয়তাে আরও দ্রুত কাজ করতে পারবে। হয়তােবা আরও বেশি নির্ভর করা যাবে তার উপর। ভবিষ্যতে কম্পিউটার প্রােগ্রামিং-এর কাজও নিশ্চয় আরও সরল হবে এবং শুধুমাত্র ইংরেজির মতাে ভাষার মাধ্যমে নির্দেশ দিয়ে নয়, মৌখিক নির্দেশের মাধ্যমেও তার সঙ্গে যােগাযােগ করা যাবে। অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে কম্পিউটারের ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পাবে। আরও বেশি সংখ্যক মানুষ কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানের এ বিস্ময়কর আবিষ্কার থেকে সুবিধা ভোগ করবে।