প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার মোকাবেলা |
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার মোকাবেলা রচনা
ভূমিকাঃ
“ আসবে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন,
কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন-
টুটবে যবে বন্ধন!
পড়বে মনে, নেই সে সাথে
বাঁধবে বুকে দুঃখ-রাতে-
আপনি গালে যাচবে চুমা,
চাইবে আদর, মাগবে ছোঁওয়া,
আপনি যেচে চুমবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে। ”
– কাজী নজরুল ইসলাম
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জিনিস হচ্ছে প্রকৃতি। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সে সাধ্যি আর কারো নেই৷ প্রকৃতি ঠিক কতখানি শক্তিশালী তার একটি প্রমাণ হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ আসার আগে তার পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও সে দুর্যোগকে কিন্তু আটকানো যায় না৷ বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই দেশটির নিত্যসঙ্গী। উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত মানুষগুলোকে বাঁচতে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সঙ্গী করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে মুহুর্তের মধ্যে তাদের চিরচেনা জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। দুর্যোগ শেষে আবার তাদের বাঁচতে হয় নতুন আশায়।
প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিঃ
বন্যা, ঘূর্নিঝড়, নদীভাঙ্গনের মত মানবসৃষ্ট নয় তেমন দুর্ঘটনা সমূহকে বলা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সহজ কথায়, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দুর্যোগসমূহ হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সাধারণত, ভৌগালিক কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ছোট হোক কিংবা বড় এর ক্ষতিকর প্রভাব পরিবেশ ও মানবজীবনের উপর দীর্ঘদিন থেকে যায়।
বাংলাদেশে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরনঃ
বাংলাদেশ প্রায় প্রতিবছরই কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী হয়। সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমূহকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ
১.বায়ুমণ্ডলে সংঘটিত দুর্যোগ (ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন, টর্নেডাে,কালবৈশাখি, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি)
২.ভূপৃষ্ঠে সৃষ্ট দুর্যোগ (ভূমিধস, নদীভাঙন, বন্যা, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিদূষণ প্রভৃতি।)
৩.ভূ-অভ্যন্তরে সৃষ্ট দুর্যোগ (ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত। যদিও বাংলাদেশে অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা নেই৷)
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাংলাদেশের অবস্থানঃ
হিমালয় ও ভারত থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তেমন নদীর সংখ্যা ৫৪টি৷ বাংলাদেশের নদীর প্রকৃত সংখ্যা এখনো জানা না গেলেও নদীবাহিত পলিমাটি ও বঙ্গোপসাগরের অবস্থান, সবমিলিয়ে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ৷ প্রত্যেক বছর বন্যা, নদীভাঙ্গন, ৮/১০ ফুট উঁচু জলােচ্ছাস উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের বসবাসরত স্থানকে পরিণত করে মৃত্যুপুরীতে৷
প্রাকতিক দুর্যোগের কারণঃ
বিজ্ঞানীরা প্রাকতিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে থাকে। প্রাকতিক দুর্যোগের সম্ভাব্য কিছু কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
১. গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।
২. কলকারখানা ও গাড়ি থেকে অতিমাত্রায় কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ে যাওয়া।
৩. মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া।
৪. পলিমাটির কারণে নদী ভরাট হওয়া।
৫. একের পর এক বন উজাড়।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমূহঃ
প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে ঘটে যাওয়া চক্রটি এনসো (ENSO) নামে পরিচিত। এই চক্রের দুটি বিপরীত অবস্থা হল এল নিনো ও লা নিনা। মূলত, এই চক্রটির প্রভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিনিয়ত হানা দেয়। বন্যা, সাইক্লোন, জলােচ্ছ্বাস, ঝড়-ঝঞা, খরা, নদী ভাঙন, ভূমিকম্প, লবণাক্ততা এদেশে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বন্যাঃ
বন্যা বাংলাদেশে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম৷ বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের বন্যা সংঘটিত হতে দেখা যায়। পাহাড়ি ঢল বা বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ঠ বন্যাকে বলা হয় আকস্মিক বন্যা৷ ঋতুর প্রভাবে বিস্তীর্ন এলাকা প্লাবিত হলে সেটিকে বলা হয় মৌসুমী বন্যা। সমুদ্রের জলোচ্ছাসের কারণে সৃষ্ট বন্যাকে বলা হয় জোয়ার-ভাটা জনিত বন্যা।
বাংলাদেশে বন্যার কারণঃ বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যার কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
১.ভারী বৃষ্টিপাত।
২.অববাহিকা অঞ্চলে প্রবল বর্ষণ।
৩. নদী গর্ভের তলাট ভরাট হয়ে যাওয়া।
৪.নদী গতিপথ পরিবর্তন।
৫.আবহাওয়ার পরিবর্তন।
বিগত দশকে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতিঃ
১৯৫৪, ‘৫৫’, ‘৬২’, ‘৬৬’ সালে সংঘটিত বন্যায় দেশে ব্যাপক ফসলহানি ঘটে।
১৯৭৪ সালের বন্যার ফলে বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্রায় ২০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৯৮ সালে ৬৪ জেলার মধ্যে ৫২টি জেলা বন্যার কবলে পড়েছিল। এ বন্যায় প্রায় ২২ লাখ টনের মত ফসলি জমি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল৷ এরপর ২০০৪, ২০০৭, ২০১৭ সালের বন্যা ছিল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসঃ
প্রচন্ড গতিসম্পন্ন বায়ু যা ঝড়ের আকার ধারণ করে তা ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়কে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির সাথে যোগ হয় জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড় তার তান্ডব চালিয়ে সাগরে মিলিয়ে গেলেও এর ভয়াল থাবার ছাপ দীর্ঘদিন থেকে যায়।
ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতিঃ
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রামে ২২৪ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়ের সাথে যোগ হয়েছিল ১০-৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। এই ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৯১ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ২২৫ কিলোমিটার। এই ঘূর্ণিঝড়ে ১২-২২ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৯১ সালের ২৯-৩০শে এপ্রিলের ‘শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়’ ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর “সিডর” খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছিল। ২২৩ কিলোমিটার গতিবেগ ও ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করা এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ২০০৯ সালের ২৫শে মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা “আইলা” নামের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার ।
ভূমিকম্পঃ
ভূমিকম্প হলে কিছু সময়ের জন্য পুরো দেশ বা কিছু শহর কেঁপে উঠে। বাংলাদেশে সিলেট ও চট্টগ্রামে ঘন ঘন ভুমিকম্প অনুভূত হয়। ২০২০ সালে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বাংলাদেশে অনুভূত হওয়া দুটো ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৪ এবং ৩ দশমিক ৭। ২০২১ সালে মে ও জুনে ঢাকায় ও তার আশপাশের এলাকায় অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩-এর বেশি।
১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অনুভূত হওয়া বেশিরভাগ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর, ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
নদীভাঙনঃ
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। নদীর মনোরম দৃশ্য অনেকের কাছে সুখের গান কবিতা হলেও কিছু মানুষের সারাজীবনের সম্পদ, তাদের বসতভিটা নদীভাঙনের কারণে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র পদ্মার ভাঙনের কবলে পড়েছে মোট এক হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা।
১৯৭৩-২০০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভোলার মূল ভূ-ভাগ থেকে ২৪০ বর্গ কিলোমিটার জমি নদীভাঙনের কারণে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর কমপক্ষে প্রায় ১০ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের শিকার হয়। প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ হেক্টর জমি নদীভাঙনের কারণে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নদী ভাঙনের ফলে এদেশে প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ ২৫ কোটি ডলার।
খরাঃ
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে দেশের তাপমাত্রা বেড়ে যায়৷ আর এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে কৃষিখাতে। কৃষিপ্রধান এই দেশে চাষাবাদের জন্য বৃষ্টির গুরুত্ব অপরিসীম। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অনাবৃষ্টির কারণে মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এই সময়টাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের চাষাবাদ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ ফলে, খাদ্য সংকট দেখা দেয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি খরায় আক্রান্ত হয়৷
টর্নেডােঃ
টর্নেডাে নামক এই স্বল্পকালীন দুর্যোগটির আঘাত হানার ব্যাপ্তি দশ থেকে বিশ মিনিট হলেও এই কম সময়ের মধ্যেই এই দুর্যোগটি কোন এলাকার ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে থাকে। এপ্রিল-মে মাসে দেশের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ থাকে৷ আর এই সময় ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল— গাজীপুর, টাঙ্গাইল, পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, গােপালগঞ্জ প্রভৃতি জেলা টর্নেডাের ঝুঁকিতে থাকে। বাংলাদেশে আঘাত হানা ৭৫% টর্নেডো সংঘটিত হয়েছে এপ্রিলের প্রথম ২০ দিনের মধ্যে৷ ১৯৮৯ সালে প্রাণঘাতী টর্নেডোতে দেশে অন্তত ১৩০০ মানুষের মৃত্যু হয় ও আহত হয় ১২ হাজার মানুষ। এ টর্নেডোতে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ বাস্তুহীন হয়ে পড়ে।
কালবৈশাখিঃ
সাধারণত, এপ্রিল ও মে এই দুইমাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখি সংঘটিত হতে দেখা যায়। বেশিরভাগ সময় বিকেলের দিকে কালবৈশাখি আঘাত হানতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও আবার শিলাবৃষ্টি হয়৷ এ সময় বিক্ষিপ্তভাবে তীব্র বায়ুপ্রবাহ, বজ্রঝড় বা ঘূর্ণিঝড় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কালবৈশাখির ভারী ঝড়বৃষ্টি ও তীব্র বায়ুপ্রবাহ অনেক অঞ্চলের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়৷
ভূমিধসঃ
ভূমিধস বর্তমানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির মত পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ। ২০১৭ সালের জুনে রাঙামাটিতে ভূমিধসে ১২০ জন প্রাণ হারায়৷ একই বছর চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানে পাহাড়ধসে অন্তত ১৬২ জনের মৃত্যু হয়। বিশেষকরে, বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে ভূমিধস বেড়ে যায়।
ভূমিধসের কারণঃ
ভূমিধস বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। যেমনঃ
১. অতিবৃষ্টি।
২. ভূমিকম্পের ফলে পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি হওয়া।
৩. পাহাড় থেকে অতিমাত্রায় বালু ও পাথর উত্তোলন।
৪. অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা।
৫. অতিরিক্ত সেগুনগাছ রোপণ।
৬. বৃক্ষরোধন৷
৭. পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন।
৮. পাহাড়ের মাটি অনুযায়ী ফসল চাষ না করে অতিরিক্ত জুম চাষ৷
বজ্রপাতঃ
বর্তমানে বাংলাদেশে নতুন একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।সেটা হচ্ছে বজ্রপাত।ভাড়ি বৃষ্টির সাথে বজ্রপাত হয়ে থাকে।এবং এর ফলে প্রতি বছর সারা দেশে ৩০০/৪০০ এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে।দিন দিন বজ্রপাত ও এর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেরেই চলছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার উপায়ঃ
প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা আমাদের কারো নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে আটকানো না গেলেও এর ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে যেমনঃ
১. খরা, জলােচ্ছাস, বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমূহ মোকাবেলার সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে বৃক্ষরোপন। উপকূলবর্তী ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিকল্পিতভাবে বনায়ন করতে হবে৷ প্রতিটি দেশের মােট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা একান্ত আবশ্যক হলে আমাদের দেশে রয়েছে মাত্র ৭% থেকে ১০% ।
২. পাহাড়ি অঞ্চলে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, গাছ কাটা বন্ধের আইনের বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে। কৃষি জমি, জলাভূমি, পাহাড় ইত্যাদি ধ্বংস করে বসতবাড়ি বা কলকারখানা নির্মাণের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে চলেছে৷ কারণ, এই বিষয়ে আইন থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না৷
৩. নদীমাতৃক এই দেশের আয়তনের অনেকাংশ জুড়েই রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য নদী৷ তবে, নদীতে বর্জ্য নিক্ষেপ, কারখানার বিষাক্ত জলের কারণে নদী তার প্রাণ হারাচ্ছে৷ বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নদীকে পরিচ্ছন্ন রাখা পাশাপাশি প্রত্যেক বছর নদীখনন করা আবশ্যক। নদীর বুকে উঁচু ও জোরালো বাঁধ নির্মাণ বন্যা মোকাবেলায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় গণসচেতনতার সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই৷ উপকূলবর্তী মানুষকে দুর্যোগকালীন ও তার পরবর্তী সময় কি করণীয় সে সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় উঁচু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। দুর্যোগ মােকাবিলায় নিয়ােজিত কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করতে হবে৷
দুর্যোগ মােকাবিলায় বিভিন্ন সংস্থাঃ
কথায় আছে দেশের বিপর্যয়ের সময় মানুষের অন্তরে সুপ্ত অবস্থায় থাকা দেশপ্রেম প্রকাশিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবিলায় বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন রাজনীতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী দল, এমনকি সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। দুর্যোগ মোকাবেলায় সাহায্য করে তেমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংস্থা হচ্ছেঃ
১. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)
২. জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশনারের দপ্তর (UNHCR)
৩. বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (WFP)
৪. খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)
৫. জাতিসংঘ শিশু তহবিল (UNICEF)
৬. জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP)
দুর্যোগ মােকাবিলায় সরকারের গৃহীত কর্মসূচিঃ
দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারি সহায়তা ব্যতীত কখনোই দুর্যোগ কবলিত মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের মত মধ্যম আয়ের দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য দুর্যোগ মোকাবেলা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। দুর্যোগ মােকাবিলায় সরকারের গৃহীত কর্মসূচি নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
১. ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মোট ২৮ হাজার ২২৭টি দুর্যোগ সহনীয় গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
২. গ্রামীণ দুর্গম জনপদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরু রাস্তা, আশ্রয়কেন্দ্র, সংযোগ সড়ক, হাট বাজার, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ধর্মীয় উপাসনালয়ে কাবিখা ও টিআর কর্মসূচির আওতায় ১২ লক্ষ ৯১ হাজার ১৬১টি সোলার সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে (২০১৬-১৭ অর্থবছর হতে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত)।
৩. দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ৮ লক্ষ ১০ হাজার ৯৫২টি পরিবারকে গৃহ নির্মাণের জন্য ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার ৩৩৫ বান্ডিল ঢেউটিন এবং নির্মাণ ব্যয় বাবদ ২৬১ কোটি ২৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা প্রদান করা হয়েছে ( ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত )।
৪. উপকূলবর্তী অঞ্চলে ৩২০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ও ২৩০টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
৫. পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর ২,৫০,০০০ কিউসেক পানি মেঘনা নদীতে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে৷ এতে করে ময়মনসিংহ, সিলেট জেলার তিন লক্ষ একর জমি বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে৷
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ছাত্র সমাজের ভূমিকাঃ
কোন দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার সে দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ। তাই, দেশে কোন বিরূপ পরিস্থিতি বা দেশ দুর্যোগের কবলে পড়লে সবার আগে এগিয়ে আসে সে দেশের ছাত্রসমাজ। এ সময় তাদের দুর্যোগ কবলিত স্থানের মানুষ জনদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে, তাদের জন্য খাবার, বিশুদ্ধ জল, ত্রাণ সংগ্রহ করতে দেখা যায়। যে সমস্ত মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে বহু তরুণেরা তাদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করে নতুন করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে৷
উপসংহারঃ
অতীতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের অগ্রিম আভাস পাওয়া যেত না বিধায় জনগণের দূর্ভোগ চরমে পৌঁছে যেত। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের মত দুর্যোগের আগাম আভাস পাওয়া সম্ভব হয়। ফলে, জনসাধারণকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়। তবে, দুর্যোগ মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া৷ ঐক্যবদ্ধভাবে যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলা করলে ক্ষয়ক্ষতি সহজে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়।