মাদকাসক্ত ও তার প্রতিকার। বাংলা রচনা ও প্রবন্ধ

মাদকাসক্ত ও তার প্রতিকার
মাদকাসক্ত ও তার প্রতিকার

ভূমিকাঃ "নেশা হচ্ছে একটা মারাত্মক ব্যাধি, যার ইতি টানতে হলে আপনাকে হয় হাসপাতালে নয় তো জেলে যেতেও  হতে পারে।" -রাসেল ব্রান্ড 

বর্তমানে আমাদের সমাজ ও দেশের জন্য মাদকাসক্তি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকের নীল নেশা এখন তার বিশাল থাবা বিস্তার করে চলেছে এ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এ যেন এক তীব্র নেশা। হাজার হাজার শিশু ও যুবকেরা এখন এ নেশায় আসক্ত। এ মরণনেশা থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করা না গেলে এ হতভাগ্য জাতির পুনরুত্থানের স্বপ্ন অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশ আজ এক সর্বনাশা মরণনেশার শিকার হয়ে যাচ্ছে। যে তারুণ্যের ঐতিহ্য রয়েছে সংগ্রামের, প্রতিবাদের, যুদ্ধ জয়ের, আজ তারা নিঃস্ব হচ্ছে মরণনেশার বিষাক্ত ছোবলে। মাদক নেশার যন্ত্রনায় ধুঁকছে শত-সহস্র তরুণ প্রাণ। ঘরে ঘরে সৃষ্টি হচ্ছে হতাশা,অশান্তি । ভাবিত হচ্ছে সমাজ,পরিবার। তাই যত দ্রুত সম্ভব  এই মাদকাসক্তির কারণ উদ্ঘাটন করে এর প্রতিকার করতে হবে।

মাদকাসক্তি কী?

মাদকাসক্তি একটি স্নায়বিক ক্রিয়া। এর প্রভাবে ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণে অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি যুব সম্প্রদায়ের এক আদিম প্রবণতা। শাব্দিক অর্থে মাদকাসক্তি বলতে ড্রাগ বা মাদকদ্রব্যের প্রতি এক প্রবল আকর্ষণকে বোঝায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, নেশা এমন একটি মানসিক বা শারীরিক অবস্থা, যার সৃষ্টি হয়েছে জীবিত প্রাণী ও মাদক ওষুধের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে।

মাদকদ্রব্য কী?

মাদক শব্দের অর্থ হল – মত্ততা জন্মায় এমন দ্রব্য। অর্থাৎ নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্যকেই মাদকদ্রব্য বলে। মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে স্নায়বিক বৈকল্য দেখা দেয় ও বারবার ওই দ্রব্য গ্রহণের প্রতি আকর্শন সৃষ্টি হয়। মাদকদ্রব্য গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল এ আসক্তি প্রশমিত হয়। অন্যথায় শরীরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। মাদক দ্রব্য তার শরীরে প্রবেশ না হয়া অব্ধি সে জানোয়ারের মত হিংস্র হতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) মাদকদ্রব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ

"নেশা জাতীয় যেকোন দ্রব্যই মদ, আর যাবতীয় মদই হারাম।"

সকল ধরনের মাদক  জাতীয় দ্রব্য হারাম হওয়া পরেও এসব দ্রব্যসামগ্রীর প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ‘মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসা গ্রহণযোগ্য নয় এমন দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণে ক্রমাগত বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করা এবং এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া’।

মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদঃ 

বর্তমান বিশ্বের  বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য লক্ষ করা যায়।আধুনিকতার  সাথে তাল মিলিয়ে মাদকদ্রব্যেরও যথেষ্ট পরিমাণে উন্নতি হয়েছে। আমারদের দেশেও সেই আধুনিকতার ঢেউ বয়ে গেছে। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকারের মাদকদ্রব্য দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে যেসব মাদকদ্রব্যের সেবন সর্বাধিক বেশি সেগুলো হলোঃ গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, রেকটিফাইড স্পিরিট, মদ, বিয়ার, তাড়ি, পঁচুই, কোকেন, আফিম, মারিজুয়ানা, ভাং, ক্যানাবিস, হাসিস, ঘুমের ওষুধ, প্যাথেড্রিন ইনজেকশন ইত্যাদি।

মাদকদ্রব্যের উৎসঃ

বর্তমান পৃথিবীতে  সব দেশেই কমবেশি মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। কোনো দেশে কম আবার কোনো দেশে অনেক  অনেক বেশি। যেমন, গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান), গোল্ডেন ওয়েজ- এ তিন স্থানে পপি উৎপাদিত হয়। এই পপি ফুলের নির্যাস থেকে আফিম এবং এই আফিম থেকেই সর্বনাশা হেরোইন তৈরি হয়। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, জ্যামাইকা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও থাইল্যান্ডসহ ১১টি দেশে মারিজুয়ানা উৎপন্ন হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, বলিভিয়া প্রভৃতি দেশ কোকেন উৎপাদনে বিখ্যাত। তাছাড়া এশিয়া মহাদেশের প্রায় অনেক দেশেই আফিম, হেরোইন ও হাসিস উৎপন্ন হয়।যা প্রতিটি দেশ,সমাজ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর।

মাদকদ্রব্য চোরাচালানঃ

মাদকাসক্তির ব্যক্তিগত দিক ছাড়াও এর আরও একটি ব্যবসায়িক দিক আছে। যা বিশাল অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য মুলত  পাকিস্তান ও ভারত থেকে পাচার হয়ে যায় পশ্চিমে ইউরোপে। বিশেষ করে গ্রেট ব্রিটেন, পসচিম জার্মানি, ইতালি ও সুইজারল্যান্ড। শ্রীলঙ্কাকে ব্যবহার করা হয় চোরাচালানের কেন্দ্রস্থল হিসেবে । তাছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের মাঝামাঝি হওয়ার ফলে বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।বাংলাদেশের বর্ডার এলাকা গুলোতে এই ব্যাবসা বা মাদক দ্রব্য চোরাচালান বেশি হয়ে থাকে।

মাদকদ্রব্যের ব্যাবহার পদ্ধতিঃ

সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক ড্রাগ ব্যবসায়ীরা নানা ধরণের মাদকের ব্যবসা ফেঁদেছে। এসব মাদকের ব্যবহার পদ্ধতিও নানারকমের। ধূমপানের পদ্ধতি, নাকে শোকার পদ্ধতি, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ত্বকের নিচে গ্রহণের পদ্ধতি এবং সরাসরি রক্তপ্রবাহে অনুপ্রবেশকরণ পদ্ধতি। বিভিন্ন রকম ড্রাগের মধ্যে হেরোইন আজ সব নেশাকেই ছাড়িয়ে গেছে। এর আসক্তি অত্যন্ত তীব্র। নিছক কৌতূহল যদি কেউ হেরোইন সেবন করে তবে এই নেশা সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো তার ঘাড়ে চেপে বসে।সে আর সেখান থেকে ফিরে আসতে পারে না।

মাদকাসক্তির কারণঃ

মাদকাসক্তির গ্রহণের অনেক ধরনের  কারণ রয়েছে। আমাদের সমাজে বিভিন্ন কারণে মাদকাসক্তির প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানী, গবেষক ও চিকিৎসকরা মাদকাসক্তির অন্তরালে বিভিন্ন কারণের কথা বলেছেন। নিম্নে তা বর্ণনা করা হলোঃ-

হতাশাঃ

মাদকাসক্তির অন্যতম প্রধান একটি কারণ হলো হতাশা। এই হতাশার করণেই ব্যক্তি তার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।পারিবারিক কারণে  হতাশা, পরিক্ষায় ভালো ফলাফল না হয়ার কারণে হতাশা, প্রেমে ব্যার্থ হয়ে হতাশায় পরে, এবং পড়াশোনা শেষ হয়েও বেকার সমস্যার জন্য হতাশা।  যার ফলে সাময়িকভাবে আত্মমুক্তির জন্য সর্বনাশা মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

সঙ্গদোষঃ

মাদকাসক্তির জন্য সঙ্গদোষ আরেকটি মারাত্মক কারণ। নেশাগ্রস্ত বন্ধু- বান্ধবের মাধ্যমে এটি বিস্তার লাভ করে।প্রথমে সিগারেট দিয়ে শুরু করিয়ে ধিরে ধিরে এর গভিরে প্রবেশ করতে থাকে। 

কৌতূহলঃ

কৌতূহলও মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। অনেকেই মাদকাসক্তির ভয়াবহতা জেনেও কৌতূহলবশত মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে।তারপরে সে-ও এর ফাদে আটকে যেতে থাকে। 

সহজ আনন্দ লাভের বাসনাঃ 

অনেক সময় মানুষ মাদককে আনন্দ লাভের সহজ উপায় হিসেবে মাদক গ্রহণ করে এবং ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলাঃ 

তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের জন্য এটি অন্যতম কারণ। পরীক্ষায় ফেল, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, বেকারত্ব ইত্যাদি কারণে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতিঃ

 ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষকে সচেতন করে তোলে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতি হওয়ার ফলে মাদকাসক্তির বিস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে।পারিবারিক ভাবেই সে ধর্ম জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়ে এই অবস্থার শিকার হয়।

পরিবারের অভ্যন্তরে মাদকের প্রভাবঃ

অনেক সময় দেখা যায় পরিবারে পিতা- মাতার নেশার অভ্যাস থাকে। ফলে তাদের সন্তান সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাঃ

বর্তমানে আমাদের দেশে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে মাদকাসক্তদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।

সুতরাং, সামগ্রিকভাবে হতাশা, আদর্শহীনতা, বিভ্রান্তি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্তি রতা, সামাজিক ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয় ইত্যাদি কারণে মাদকাসক্তির সংখ্যা দিন দিন বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মাদকাসক্তির লক্ষণঃ

প্রতিটি রোগের মতো মাদকাসক্ত ব্যাক্তিদের মাঝেও কিছু লক্ষন রয়েছে।যা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে সে মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে পরেছে।মুলত, যখন কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তখন তার মধ্যে কিছু কিছু লক্ষণ ও চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। যেমন : আচারআচরণের পরিবর্তন; রাতে ঠিকমতাে ঘুম না হওয়া এবং দিনে বসে বসে ঝিমানাে; গুছিয়ে কথা বলায় অপারগতা; খাবার গ্রহণের প্রতি অনীহা, চিত্তচাঞ্চল্য, মেজাজ কখনও খুব ভালাে, কখনও খুব খারাপ থাকা; মনােযােগ দেওয়ার ক্ষমতা কমতে থাকা; আড্ডায় বেশি সময় নষ্ট করা; আর্থিক চাহিদা বাড়তে থাকা; দিনের একটি বিশেষ সময়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য মন চঞ্চল হয়ে ওঠা; শরীর ও স্বাস্থ্যের অবনতি  হওয়া ইত্যাদি।

মাদকাসক্তির কুফলঃ

"নেশা তার পথে যা কিছু পায় সব কিছুই ধংস করে দিয়ে যায়।"

মাদকাসক্তি একটি  মরণ নেশা। মৃত্যুই তার একমাত্র সমাধান । মাদক গ্রহণ ধীরে ধীরে স্নায়ুকে দুর্বল করে দেয়। শরীরের রোগ- প্রতিরোধ ক্ষমতা আস্তে আস্তে নিঃশেষ করে দেয়। তাছাড়া ক্ষুধা ও যৌন অনুভূতি হ্রাস পেতে থাকে। মাদক গ্রহণে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। হৃদস্পন্দন দ্রুত হয় এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। রাগান্বিতভাব, নিদ্রাহীনতা, উগ্র মেজাজ, ওজন হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতায় ক্ষতিকর প্রভাবসহ মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে এইচআইভি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এককথায় মাদকাসক্ত মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।এর থেকে ফিরে আসা অনেক কষ্টের।

মাদকাসক্তির প্রভাবঃ

     "নেশা হচ্ছে একটি পারিবারিক সমস্যা, পরিবারের একজন নেশা করলেও এর মাশুল দিতে হয় পরিবারের সবাইকে "

সারাবিশ্বে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও চোরাচালানের মাধ্যমে এর ব্যাপক বিস্তারের কারণে  ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি এক মারাত্মক হুমকির মুখে পরেছে।  মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে অকালে ঝরে পড়ছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ । অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু তরুণের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ-

যুবসমাজের ওপর প্রভাবঃ

মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার আমাদের দেশের যুবসমাজের ওপর সবচেয়ে বেশি  ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। যার ফলে যুবসমাজের বিরাট একটা অংশ অবচেতন ও অকর্মণ্য হয়ে পরছে।যার ফলে ধংস হচ্ছে যুব সমাজ। 

সামাজিক বিশৃঙ্খলা : 

মাদকাসক্ত ব্যাক্তি সমাজের জন্য বিপদ জনক হয়ে উঠে। কেননা, মাদকাসক্তরা মাঝে মাঝে মাদকগ্রহণের জন্য চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে। যার ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়।

শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি : 

নেশা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে তারা মারাত্মকভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবার ও সমাজে তারা বিভিন্ন অস্বাভাবিক আচরণ করে।

পারিবারিক ভাঙন ও হতাশা বৃদ্ধি : 

মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির প্রভাবে আমাদের সমাজে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ এবং এ সম্পর্কিত হতাশা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। পারিবারিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নষ্ট হয়।বৃদ্ধি পাচ্ছে হতাশ ও অস্থিরতা। 

নৈতিক অধঃপতন : 

মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বাহ্যিক আচরণ প্রকাশ পায়। যেকোনো ব্যাপারে তখন ব্যক্তির মধ্যে চরম নৈতিক অধঃপতন লক্ষ করা যায়।যা তার ব্যক্তিত্বের অবক্ষয় করে।

শিক্ষার ওপর প্রভাব : 

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু অনেক মেধাবী ও ভালো ছাত্রছাত্রী মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবনকে নষ্ট করছে। তাই দেখা যায় মাদকাসক্তি সমস্যা আমাদের দেশের শিক্ষার ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে।

মাদকের নেশা দ্রুত প্রসারের কারণঃ

গবেষণায় করে দেখা গেছে যে, প্রায় ক্ষেত্রে হতাশা ও দুঃখবােধ থেকে সাময়িক স্বস্তিলাভের আশার উদ্দেশ্যেই এই মারাত্মক নেশা ক্রমবিস্তার লাভ করছে। পাশাপাশি এটা ও সত্য যে, অনেক দেশে বিপথগামী মানুষ ও বহুজাতিক আর্থিক সংকট ও উৎকট অর্থ লালসায় পরে বেছে নিয়েছে রমরমা মাদক ব্যবসার পথ। তার  সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বিভিন্ন দেশের মাফিয়া চক্র। মাদকের ঐ কারবারিরা সারা বিশ্বে তাদের ব্যবসা ও হীনস্বার্থ রক্ষায় এই নেশা পরিকল্পিতভাবে ছাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়াঃ

মাদকদ্রব্যের ভয়াবহ অবস্থা  বিশ্বের জন্যে আজ চিন্তার বিষয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজজীবনে এটা এক নম্বর সমস্যা। ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট ২০২২ অনুসারে ২৮৪ মিলিয়ন মানুষ মাদকে আসক্ত। যাদের বয়স ১৬ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। যা বিগত বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় মাদকে আসক্তদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দিন দিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা শুধু এখন ইউরােপ-আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই অশুভ ছায়া এশিয়া-আফ্রিকার দেশে দেশে ইতােমধ্যেই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশে মাদকের বর্তমান পরিস্থিতিঃ

বাংলাদেশে মাদকের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা চরম আকার ধারণ করেছে । দিন দিন এর অবস্থার অবনতি ঘটছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলাের মতো  আমাদের দেশেও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশের  তরুণরা এখন ভয়াবহ মাদকাসক্তির শিকার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি মাদকসেবী রয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি মাদকাসক্ত।শেখ জাহাঙ্গীর আলম, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬, দেশে মাদকসেবী দেড় কোটি, মাদকবিক্রেতা ৩০ লাখ – প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে থাকেন তারা। এ হিসাব অনুযায়ী, মাসে তারা প্রায় ৬শ’ কোটি টাকার মাদক সেবন করেন। দেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকার মাদক কেনা-বেচা করে থাকেন। দেশে শতকরা ১০ জন নারী মাদকাসক্ত, এদের মধ্যে তিন জন গৃহবধূ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বন্ধুদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। আর মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ যুব সমাজ কৌতুহলবসত মাদক সেবনে ঝুঁকছে।স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, জুন ৩০, ২০২২, ৮০ শতাংশ মাদকাসক্তই তরুণ-যুবক! –সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মাদকসেবীদের ৮০ শতাংশই যুবক। যদিও কোনো মাদক বাংলাদেশে উৎপাদন করা হয় না। তবুও বিমান, স্থল ও নৌপথে দেশের সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে মাদক প্রবেশ করছে। এসব সরবরাহ পাচার ও বাজার তৈরির কাজে সহযোগিতা করছে দেশের আভ্যন্তরীণ মাদক কারবারিরা। ব্যবহৃত হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ, নারী ও শিশুরা। নতুন নতুন কৌশল খাটিয়ে প্রাইভেট-কারে, সবজি-বাহী ট্রাক, ফলের ঝুড়ি, ট্রাকের পাটাতনের নিচে বিশেষ কায়দায় মাদক সরবরাহ করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের উপায়ঃ

মাদকদ্রব্যের ব্যাপক বিস্তার ও তার ব্যবহার বর্তমান বিশ্বে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এ জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ  হয়ে পড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-

১.মাদকদ্রব্য উৎপাদন ও আমদানি রোধ করার জন্য প্রতিরোধ কর্মসূচি আরো জোড় থেকে জোরদার করা।

২.মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তােলা।

৩.সমাজের প্রত্যেক মানুষকেই মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা।

৪.বেকারত্ব হ্রাস করা এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা।

৫.স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বইয়ে মাদকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা।

৬.আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকরী ভূমিকা পালন করা।

৭.সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি করা।

৮.সভা, সমিতি, সেমিনার ও আলোচনার মাধ্যমে মাদক প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা।

৯.মাদক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রনসংস্ক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করা।

১০.মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ভেষজ ও মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ।

১১.সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে তরুণদের সম্পৃক্ত করে নেশার হাতছানি থেকে তাদের দূরে রাখা।

১২.মানবিক মূল্যবোধ গঠন ও পরিবেশন।

১৩.পিতা-মাতা কর্তৃক শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ।

১৪.ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি।

বিশ্বজুড়ে মাদক-বিরোধী আন্দোলন বনাম বাংলাদেশ:

বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম মাদকপ্রতিরোধ আন্দোলন করেছিল।। এরপর ১৯৮৭ সালে বিশ্বর ২৩টি রাষ্ট্র মাদক প্রতিরোধ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগদান করে। মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ইরানে ৩১ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে ঢাকার তেজগাওয়ে স্থাপিত মাদক চিকিৎসা কেন্দ্র কাজ করছে। খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে আরও তিনটি মাদক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

মাদকাসক্তি প্রতিরোধ চিন্তাঃ

বিশ্বজুড়ে যে মাদক নামক বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। তার হিংস্র  থাবা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ও গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছেন। সমাজসেবীরা উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশে  নানা সংস্থা ও সংগঠণ মাদকবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। বেতার, টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদি গণমাধ্যম মাদকবিরোধী জনমত গঠণে সক্রিয় হয়েছে।

সমাজের নেতাদের কর্তব্যঃ

মাদকদ্রব্যের প্রচার ও প্রসার প্রতিরোধে  সমাজের নেতারা নিজ নিজ স্থান থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন। কোনো এলাকার নেতা বা সর্দার যদি মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন, তবে সে এলাকায় মাদকের অবাধ ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে।কিন্তু বর্তমান বিশ্বে ঠিক তার ভিন্ন রূপ দেখা যায়। তার অর্থ উপার্যনের নেশায়,উল্টো মাদক ব্যবসায়ীদের সাহায্য করে থাকে। 

আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা:

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থা তথা সরকারের। কেননা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধ প্রবণতা দমন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই সরকারের প্রধান দ্বায়িত্ব। শক্ত হাতে মাদকাসক্তির মতো অন্যতম অপরাধ দমন করতে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্তব্যঃ

মাদকদ্রব্য যেহেতু সারা পৃথীবির জন্য বিপদজনক  তাই বিশ্বের সকল দেশের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। এর উৎপাদন, বিপনন ও পাচার রোধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে সচেতন হতে হবে।এবং উন্নত দেশ গুলো কে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা কোনো কোনো দেশে প্রকাশ্যেই এবং অনুষ্ঠানে প্রধান পানিয় হিসেবে মাদক পান করা হয়।তাই আগে তাদের দেশের এই রীতিনীতি গুলো বর্জন করতে হবে। তাহলে এ ব্যবস্থার উত্তোরণ অনেকাংশে সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এজন্য সকল দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সজাগ থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।

মাদকাসক্তির প্রতিকার ও বাংলাদেশঃ

মাদকাসক্তির প্রতিকার আন্দোলনে বাংলাদেশের ভূমিকা দিন দিন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বর্তমানে (আমরা ধূমপান নিবারণ করি) সংস্থাটি মাদক নিরাময় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদি গণমাধ্যমগুলোও সব সময় মাদক নিরাময়ে কাজ করছে। তারা সবসময় মাদকাসক্তির ভয়ানক পরিণাম নিয়ে বিভিন্ন নাটক প্রচার করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। এছাড়া বাংলাদেশে বর্তমানে Narcoties Control Act 1990 চালু আছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও প্রতি বছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের পাচার, অপব্যবহারবিরোধী দিবস পালন করে আসছে।বাংলাদেশের সীমানায় সীমান্ত বাহিনীরা মাদকদ্রব্য পাচার কমাতে বিশেষ ভুমিকা পালন করছে।সীমান্ত এলাকায় বিশেষ পাহারার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এবং প্রতিবছর মাদক পাচারকারী চক্রগুলো গুলো কে হাতে নাতে ধরে মাদকদ্রব্য ধংস করা হয়, এবং তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।

উপসংহারঃ

প্যাথিড্রিন, হেরোইন, নেশার আস্তানা,
দুমড়ে মুচড়ে দিতে ধরো হাতখানা
চলো প্রতিরোধ গড়ে তুলি প্রতিবিশ্বের প্রান্তর জুড়ে
মরণ আসে যদি তবু  পিছু ফেরোনা।"

ভীরু খুঁজে সাহস, দুর্বল খুঁজে শক্তি, দুঃখী খুঁজে সুখ। কিন্তু অধঃপতন ছাড়া তারা আর কিছুই পায় না।  আধুনিক সভ্যতার এই যুগে এসে মাদকাসক্তির কালসাপ রুপ ধারণ করেছে। যার ছোবলে হারিয়ে যাচ্ছে অজস্র তরুণ-তরুণীর সম্ভবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এর প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমেই বেড়ে চলছে। মাদক প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মাদকের অতল গর্ভে হারিয়ে যাবে আমাদের দেশের সম্ভবনাময় ভবিষ্যৎ। তাই মাদক প্রতিরোধের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সামাজিক প্রতিরোধ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা উচিত।


হাবিবা আফরিন

আমার নাম হবিনা আফরিন । ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি আমার শখ। sorolmanus.com আমার সেই শখ পুরণে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আশা করছি আমার লেখার মাধ্যমে আপনারা উপকৃত হবেন। সবাই আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Ads

Ads