বর্ষাকাল। বাংলা প্রবন্ধ ও রচনা |
বর্ষাকাল। বাংলা প্রবন্ধ ও রচনা
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। নানা ঋতুতে এর প্রকৃতি নানান সাজে সজ্জিত হয়। এদেশের প্রতিটি ঋতুই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ঠিক তেমনি বর্ষায় বাংলাদেশ যেন এক অপরূপ চিত্রে ফুটে ওঠে। ঋতুচক্রের পালায় এক সময় বর্ষা আসে বাংলাদেশে। আসে তার সিন্গ্ধ সজল রূপ নিয়ে। বসন্তকে আমরা ঋতুরাজ বলি, কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বর্ষাই বাংলার প্রিয় ঋতু। তাছাড়া এদেশে বর্ষার রূপ যতটা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে অন্য কোনাে ঋতুর ক্ষেত্রে তা ঘটে না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ছন্দ-হিন্দোল কবিতায় বর্ষার রূপ বর্ণনা করেছেন এভাবে-
বর্ষাকালের সীমারেখাঃ
ব্যাপ্তিতে, বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের বর্ষাকালের তুলনা নেই। ঠিক কোন দিনটিতে যে বর্ষার আবির্ভাব, আর কোন দিনটিতে যে তার সমাপ্তি, হিসেবের খড়ি দিয়ে তার সীমারেখা টানা দুষ্কর। মহাকবি কালিদাস “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে” মেঘের আবির্ভাব দেখেছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে অশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বর্ষার পরিধি বিস্তার। তবে আষাঢ়-শ্রাবণেই বর্ষার পরিপূর্ণ রূপ দেখা যায়। গর্জনে, বর্ষণে, চিত্রবিন্যাসে এ দু মাসেই তার পূর্ণনতা।
ঋতুচক্রে বর্ষার স্থানঃ
ঋতুচক্রে গ্রীষ্মের পরই বর্ষার অবস্থান। আষাঢ় – শ্রাবণ মাস বর্ষার লীলাখেলার প্রশস্থ সময়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বর্ষাকাল এ দুমাসের গন্ডিতে আবদ্ধ থাকে না। কালবৈশাখীর গুরুগর্জনে তার আগমনবার্তা সূচিত হয়। আর ভরা ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন পর্যন্ত রূপের পসরা সাজিয়ে সে অবস্থান করে। আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাসেই ঘটে তার উন্মুক্ত প্রকাশ। এসময় সে আপন মনের মাধুরী সাজিয়ে বাংলার প্রকৃতিকে সবুজে সবুজে একাকার করে তোলে। কবির ভাষায় –
বর্ষার আগমনঃ
বর্ষার আগমনরীতি যেমন বিচিত্র, তেমনি অভিনব। লুকোচুরি যেন সে পছন্দ করে না। এক মনােহর সংগীতের তালে রুমুঝুম ছন্দ তুলে সময় চরাচরকে জানিয়ে সে আসে। আকাশে নবীন মেঘের সমারােহে, গুরুগুরু গর্জনে, বিদ্যুতের শিহরনে, অশান্ত বারিপাতের শব্দে ঘােষিত হয় তার আগমনি বার্তা। তার সুশীতল স্পর্শে প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়।
বর্ষার অবিরল অবিচ্ছিন্ন ধারায় নদী-নালা, খাল-বিল, মাঠ-ঘাট সব পানিতে একাকার হয়ে যায়। এ সময় গ্রামগুলাে তরুলতা সমাচ্ছন্ন দ্বীপের আকার ধারণ করে। বনে বনে ফুটে জুঁই, কেয়া, কদম ইত্যাদি সুরভিত ফুল। রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধ আর অপূর্ব সংগীতে ভরে ওঠে বাংলার আকাশ বাতাস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাই তাে গেয়েছেন –
বর্ষার বৈশিষ্ট্যঃ
বর্ষার আকাশ সারাদিন মেঘাচ্ছন্ন থাকে, সূর্যের দেখা মেলে না। নদী-নালা, খাল-বিল, মাঠ-ঘাট সব পানিতে টইটম্বুর থাকে। সারাদিনই অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে। কবির ভাষায়বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর। কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে। গ্রীষ্মকালের শুষ্ক নদী নিমেষেই ভরে যায়। দু কূল ছাপিয়ে ছলছল করে বয়ে চলে পানি। নদ-নদী সৰ নবযৌবনের রূপ ধারণ করে।
বর্ষায় গ্রাম-বাংলার চিত্রঃ
যতদূর দৃষ্টি যায় আকাশে পাংশুটে মেঘের জাল বােনা, প্রকৃতি নিথর নিস্তদ্ধ। বর্ষায় গ্রাম-বাংলার অপরূপ শ্যামশ্রী সত্যিই অনির্বচনীয়। তার ধূলি-মলিন বিবর্ণতার অবসান হয়েছে। শুক্ষতার দীনতা গেছে মুছে। দগ্ধ তৃণভূমিতে জেগেছে প্রাণের হিল্লোল। সর্বত্রই শ্যামল সবুজের নয়ন নন্দন সমারােহ। বর্ষাকালে পল্লির মাঠ-ঘাটে জল থইথই করে। এ দৃশ্য যেন নিপুণ শিল্পীর হাতে আঁকা কোনাে ছবি । দিগন্ত বিস্তৃত পানিতে একাকার মাঠের প্রান্তদেশে বাড়িগুলাে তালতমাল, নারকেল, আম-জাম গাছের কুঞ্জ নিয়ে পানির ওপর ভাসতে থাকে। বর্ষার বারিধারা নদীতে যে প্লাবন সৃষ্টি করে তাতে সমগ্র পথ-ঘাট, বন-প্রান্তর ভরে যায়। বর্ষাপ্লাবিত গ্রামবাংলার এ সৌন্দর্যের কোনাে তুলনা নেই। ভরা নদনদীর বুকের ওপর দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসের দোলায় যে ঢেউ খেলে যায়, তা এক অসাধারণ সৌন্দর্যের আধার। বর্ষায় বাংলাদেশ সাজে এক অপরূপ সাজে। কবির দৃষ্টিতে তা ধরা দেয় এভাবে-
ধান্যশীষ তার করছে বিস্তার
তলিয়ে বন্যায় জাগছে জুলজুল।
নদীর বুকে অজস্র নৌকার ছুটাছুটি, ডিঙি-নৌকায় জেলেদের মাছ ধরা, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে পদ্মার ইলিশ শিকার, কলার ভেলায় চড়ে ছােট ছেলে-মেয়েদের শাপলা ফুল আহরণ সবই বর্ষার দান। কদম, কেয়া, জুই, কামিনী, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসবে বক্ত-প্রকতির হৃদয়ের দ্বার যেন খুলে যায়। তাই কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
গুরু গুরু ডাকে দেয়া, ফুটিছে কদম কেয়া
ময়ূর পেখম তুলে সুখে তান ধরছে
বর্ষার ঝরঝর সারাদিন ঝরছে।
চারদিকেই বর্ষার মুক্তা-মুরগ-মুরগীর সুর-মূৰ্ছনা। কখনাে অবিরাম ধারাবর্ষণ, কখনাে ক্ষণবর্ষণ। কখনাে আলো আঁধার। মেঘ-রৌদ্রের সকৌতুক থেলা। বার্ষিক মােট বৃষ্টিপাতের ৮০ ভাগেরও অধিক বর্ষাকালেই সংঘটিত বৃষ্টিপাতের কারণে অধিকাংশ প্রবনভূমিই বর্ষাকালে প্লাবিত হয়।
বর্ষায় শহরের চিত্রঃ
বর্ষায় গ্রামের জীবন মনোমুগ্ধকর হলেও শহরে কিন্তু তার উল্টোটা লক্ষ্য কিরা যায়।শহরে বর্ষাকাল বেশিরভাগ সময় ভোগান্তির কারণ হয়ে দারায়।একটু বেশি বৃষ্টি হলেই শহরের রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যায়। এ-সময় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়।শিক্ষার্থীদের স্কুলে যেতে কষ্ট হয়।দিনমুজুরেরা বর্ষাকালে কর্মহিন হয়ে পরে।ড্রেনের নোংরা পানিতে বিভিন্নরকম রোগ ছড়িয়ে পরে।শহরের জিনগনের বাজারে যেতে ও অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
জনজীবনে বর্ষার প্রভাবঃ
পল্লিবাসী কৃষকের জন্য বর্ষা নিয়ে আসে সবুজ শস্যের সওগাত। বর্ষার জলে ধান ও পাট পরিপুষ্ট হয়। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে ক্লিষ্ট পল্লিবাসীর জীবনে বর্ষা আনে অনাবিল শান্তি ও পরিতৃপ্তি। কৃষক এ সময়ে বৃষ্টির জলে মনের আনন্দে কাজ করে। তবে বর্ষা গ্রামীণ মানুষের জীবনে আনন্দের সঙ্গে দুঃখ এবং কষ্টও বয়ে আনে।
এসময় অনবরত বৃষ্টিপাতের ফলে রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে যায়। নদীগুলােতে সর্বনাশা বান ডেকে কৃষকের সব আবাদি ফসল এবং গবাদি পশু কেড়ে নিয়ে যায়। বাড়িঘর ডুবে যায়, কিংবা অর্ধ ডুবন্ত অবস্থায় পানির ওপর ভাসতে থাকে। পায়ে হেটে চলাচল করা এসময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ডিঙি নৌকা কিংবা কলার ভেলাই হয় পারাপার কিংবা যাতায়াতের একমাত্র বাহন। এ সময় নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক বেড়ে যায়। গ্রামের বহু লােককেই এসময় অনাহার কিংবা অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়। তাছাড়া বর্ষাকালে জ্বর, আমাশয়, ডায়রিয়া ইত্যাদি রােগের প্রকোপ অত্যধিক বেড়ে যায়। এ সময় ডায়রিয়া এবং আমাশয়ে বহু লােকের মৃত্যু হয়। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে এসব রােগ ছড়িয়ে পড়ে বেশি। মাঝে মাঝে এ রােগগুলাে মহামারি রূপ ধারণ করে। বন্যার করা গ্রাসে নিপতিত হয়ে এ সময় বহু লােক সর্বস্বান্ত হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ভিড় করে। বেঁচে থাকার জন্য তারা ব্যস্ত নগরী পূতিগন্ধময় বস্তি কিংবা রাজপথ আঁকড়ে পড়ে থাকে। বর্ষাকাল, তাই অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়। বড়লােকের আরামে দিন কাটাবান উপযুক্ত সময় এ বর্ষাকাল। কিন্তু গরিবের জন্য বর্ষাকাল যথেষ্ট দুর্ভোগের কারণ। শহরের চঞ্চল মানুষের জন্য বর্ষা বেশ বিঘ্ন ঘটায় । অফিসে যাওয়ার পথে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামা কিংবা অফিস থেকে ফেরার পথে বৃষ্টিতে আটকে যাওয়া বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মাঝে মাঝে মানুষের কাছে বর্ষা নিয়ে আসে স্বস্তি, আরামের এক সিন্গ্ধ পরিবেশ।
বর্ষা ও বাংলার অর্থনৈতিক জীবনঃ
বর্ণবিলসিত ঋতুচক্রের মধ্যে বর্ষাই বাঙালির সবচেয়ে আদরের ঋতু। সজল মেঘমেদুর অপরূপ বর্ষার সঙ্গে রয়েছে বাঙালির আজন্মকালের হূদয়বন্ধন। এ ঋতু বাঙালির জীবনে এনে দেয় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। তার ভাবজীবনকে করেছে বিচিত্র রসসম্পদে সমৃদ্ধ। বর্ষার ক্লান্তিহীন ধারাবর্ষণ, বজ্রবিদ্যুৎ, ঝড়, বন্যা-তাণ্ডব, উপেক্ষা করেও বাংলার কৃষক মাঠে মাঠে সবুজ সতেজ প্রাণের করে আবাহন। রৌদ্র-জলে মাখামাখি হয়ে সে বীজ বােনে। রােপণ করে চারাগাছ। শস্যশিশুর কলকল উচ্ছ্বাসে তার চোখে লাগে অনাগত দিনের স্বপ্ন-নেশা। ভরে ওঠে নতুন দিনের আশ্বাসে। বর্ষার অকৃপণ প্রসন্ন দাক্ষিণ্যে বাংলার মাঠ-প্রান্তর হয় শস্যশ্যামলা। বর্ষাকালই আনন্দ-ঘন নবান্ন উৎসবের নেপথ্য মঞ্চ। আবার তারই অপ্রসন্ন, অভিমানী দৃষ্টিতে ঘরে ঘরে অন্তহীন দুঃখের আঁধার হাহাকার। অতি বর্ষণে তার ভয়াল সংহাররূপে মানুষ আতঙ্কিত, ভীত সন্ত্রস্ত। শ্যাম-গম্ভীর বর্ষা একদিকে যেমন গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে আশীর্বাদ, অন্যদিকে সে-ই আবার দরিদ্র পল্লিবাসীর দুঃখের কারণ। তবু বর্ষা বাংলাদেশের অর্থনীতিসমৃদ্ধ জীবন-প্রবাহের এক অপরিহার্য কল্যাণী-ঋতু।
বর্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবনঃ
শুধু অর্থনৈতিক জীবনে নয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক, ভাবগত জীবনেও বর্ষা ঋতুর রয়েছে অনন্য ভূমিকা। বর্ষার সরস সজল স্পর্শ, শুধু বাংলার রুক্ষ ধূসর প্রান্তরকেই অসীম প্রাণপ্রবাহে স্পন্দিত করে নি, বাঙালির মনকে করেছে সরস। করেছে নব নব সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে উদ্বুদ্ধ। তার শ্যামল নীলিমায় দূর-দিগন্তে বাঙালি ছড়িয়ে দিয়েছে তার মুক্ত মনের বিহঙ্গ ডানা। বর্ষা শুধু তৃষ্ণার্ত ধরিত্রীর মরুবক্ষকেই সিক্ত করে নি, মর্তমানুষের মনকেও করেছে বিচিত্র ভাবরসে সঞ্জীবিত। বাঙালির গৃহাঙ্গন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা উৎসব-আনন্দে। রচিত হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। উৎসব আয়ােজন এই ঋতুরই উপযুক্ত পটভূমি। রচনা করেছে কত সঙ্গীত, কত কাহিনি। স্নিগ্ধ-সজল পটভূমিতে সে আয়ােজন করেছে বর্ষামঙ্গল, বৃক্ষরােপণ ইত্যাদির অনুষ্ঠান, বর্ষা বাঙালির জীবনে এনে দিয়েছে নতুন ছন্দ-সুষমা। তার মনয়ে করেছে কল্পনা বিলাসী। হৃদয়কে দিয়েছে নিত্য নতুন ভাব-সম্পদের সন্ধান। চরিত্রকে করেছে কোমলে-কঠোরে সহনীয়।
বর্ষা ও বাংলা সাহিত্যঃ
বর্ষা বাঙালিকে দিয়েছে প্রয়ােজনের জগৎ থেকে অপ্রয়ােজনের জগতে অনন্ত অভিসার-বাসনা। তার মনােভূমি হয়েছে নিত্য নবীন ভাবরসে সিক্ত। বর্ষার স্নিগ্ধ-সজল মায়াঙ্গনে যুগে যুগে কবি-হৃদয় উদ্বেল হয়েছে। বর্ষাকে সে জানিয়েছে স্বাগত অভিবাদন। পাড়ি দিয়েছে সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ পথে। বর্ষা বাঙালির মনভূমিকে করে সরস এবং কাব্যময়। বর্ষার মনােরম প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের মনকে বিমােহিত করে। বাংলাদেশের বহু কবির জীবনে বর্ষার প্রভাব সুস্পষ্ট। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাব্যে বর্ষা বিরাট স্থান দখল করে আছে। তাছাড়া গােবিন্দ দাস, অক্ষয় কুমার বড়াল, জসিমউদ্দীন প্রমুখ কবি বর্ষা সম্বন্ধে প্রচুর কবিতা লিখেছেন।
মানবমনে বর্ষার প্রভাবঃ
বর্ষার মেঘমেদুর আবহাওয়া, বৃষ্টির অবিরল ধারা, টাপুরটুপুর শব্দ মানুষের মনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এ সময় মানুষ হারানাে অতীতকে রােমন্থন করে আনন্দ পায় । অতীত দিনের স্মৃতিগুলাে একের পর এক ভেসে ওঠে তার মানসপটে। উদাস দৃষ্টিতে সে জলপতনের দৃশ্য দেখে। কবিগুরু মানবমনে বর্ষার প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাই বলেছেন –
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘন ঘাের বরিষায়।
কবির দৃষ্টিতে বর্ষা গভীর অর্থব্যঞ্জনায় বিধৃত। বর্ষা হল অবকাশের, নিষ্প্রয়ােজনের ঋতু। কবি বলেছেন-
আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে জানিনে জানিনে
কিছুতে কেন যে মন লাগে না।
ঝরঝর মুখর বাদল দিনে।
বর্ষাকালের ফুলঃ
প্রকৃতিতে ফুলের সমাহার নিয়ে বর্ষা আসে। বাহারি ফুলের সুবাসে মুখরিত হয় প্রকৃতি। ফুলে ফুলে শোভিত হয় চারপাশ। বর্ষায় ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কদম, বকুল, কলমি ফুল, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুল নার্গিস, দোপাটি, অলকানন্দ, রঙ্গন।
কদম : বর্ষা মানেই কদম ফুল। গ্রামে গাছে গাছে ফুটে থাকা কদমফুল বর্ষার প্রকৃতিতে এনে দেয় নজরকাড়া সৌন্দর্য। কদম গাছ দীর্ঘাকৃতির ও বহু শাখাবিশিষ্ট। কদম ফুলের আদি নিবাস ভারত, চীন ও মালয়। গ্রামাঞ্চলে নদীর তীরে, খোলা প্রান্তরে প্রচুর কদম গাছ চোখে পড়ে। শহরে দেখা মেলে পার্কে ও উদ্যানে। কদম গাছের ছোট ডালের আগায় গোল হয়ে কলি ও ফুল ফোটে।বকুল : বকুল ফুল শুকিয়ে গেলেও এর সুবাস অনেক দিন থাকে। তাই একে সুবাসিত ফুল বলা চলে। পাঁচ বৃন্তের এ ফুলে অসংখ্য পাপড়ি থাকে।শাপলা : বিল-পুকুর ও জলাশয়ে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা ফুটে থাকার দৃশ্য গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে। আমাদের দেশে সাদা, গাঢ় লাল, নীল ও গোলাপি রঙের শাপলা বেশি দেখা যায়।কচুরিপানা : প্রকৃতির নান্দনিক আরেক সৌন্দর্য কচুরিপানার ফুল। খুব অবহেলিত হলেও এর সৌন্দর্য হূদয় কাড়ে। গ্রামাঞ্চলের খাল, বিল, পুকুর ও জলাশয়ে প্রচুর কুচুরিপানা হয় এবং গাঢ় সবুজ পাতার ওপর সাদা আর বেগুনি রঙের মিশেল ফুলগুলো দেখতে দারুণ লাগে।
বর্ষণমুখর সকালের অনুভূতি : সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মনে হচ্ছিল যেন সন্ধ্যার আঁধার এসেছে ঘনিয়ে। নিত্যদিনের মতাে খােলা জানালার পাশে । বই নিয়ে পড়তে বসেছিলাম। একটু পরেই বৃষ্টি নামলাে। চারদিক আরও ঘন অন্ধকার হয়ে এল। এমন বাদলা দিনে কি পড়ায় মন বসে? কোন এক স্বপ্নপুরীর কল্পনায় মন ভেসে যেতে চায়, রঙিন স্বপ্নের মালা গেঁথে চলে। চেয়ে আছি দূরের কাজল কালাে মেঘের পানে। কবিগুরুর হৃদয়স্পর্শী আবেগ হৃদয়ে এক অপূর্ব অনুভূতি জাগায়— ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে। ময়ূরের মত নাচেরে। কতক্ষণ ধরে কী ভাবছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ পাশের বাড়ির টেপ রেকর্ডার থেকে ভেসে এল মন উদাস করা রবীন্দ্রসংগীতের সুর-
বর্ষা প্রকৃতি যেন নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার কল্পনাবিলাসী মন মুক্ত বিহঙ্গের মতাে পাখনা মেলে উড়ে চলেছে এক স্বপ্নময় কল্পলােকে। এই বর্ষণমুখর সকালে রাখাল বালকেরা গরুর পাল নিয়ে মাঠে নেমেছে। গাভী হাম্বা রবে বাচ্চা খুঁজে ফিরছে। গ্রাম্যবধূ কলসি নিয়ে চলেছে জলের ঘাটে। খােলা জানালার কাছে সারিসারি গাছগুলাে বরষার জলধারায় প্রাণভরে স্নান করছে আর পাতা নেড়ে প্রাণের আবেগ প্রকাশ করছে। ছােট শালিক পাখিটি ডুমুর গাছের পাতার নিচে বসে একমনে কী যেন ভেবে চলেছে। এমনই বর্ষণমুখর প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করার বাসনা মনের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে। মেঘের কালাে ঋপির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল দিনের সূর্য। মেঘের কালাে ছায়ায়, বৃষ্টিতে, ঝড়ােহাওয়ায়, ঘন ঘন মেঘের গুরু গুরু ডাকে অদ্ভুত।
বর্ষণমুখর সন্ধ্যার বর্ননাঃ
সূর্যের মুখ দেখা যায় নি সারাদিন। পুরাে দিনটাতেই ছিল সন্ধ্যার আমেজ। ধীরে ধীরে বৃষ্টির ফোঁটা মিলিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। কেবল শব্দ শােনা যেতে লাগল একটানা জল পতনের। সন্ধ্যার অবসান হচ্ছে। পাশের ডােবা থেকে ব্যাঙের প্রমত্ত ডাক শােনা যাচ্ছে। সে যেন এক কনসার্ট। দূরে দেখলাম একটা জোনাকি জ্বলে ওঠল। কিন্তু বৃষ্টির দিনে তাে জোনাকি জ্বলে না। তবে কী? না, লণ্ঠন হাতে কে যেন গােয়ালে গরু বাঁধছে। যারা বাইরে ছিল তারা সকলেই ভেজা দেহে গৃহের অভিমুখে ফিরছে। সমস্ত আকাশ জুড়ে এমনই কালাে মেঘ যেন এক্ষুণি একটা ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে। বর্ষণধারা আরও বাড়ল। সেই সঙ্গে বিদ্যুতের আলােকে যেন ত্রিনয়নের আগুন জ্বলে ওঠছে। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার তীব্র গতিতে গাছপালাদের উন্মত্ত ঝাঁকুনি, এমনকি বাড়িটাও যেন কেঁপে ওঠল। প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ার শব্দে আতঙ্কিত নৃত্য শুরু হলাে। ঝড় থেমেছে কিন্তু তখনাে বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানাে আলাের ঝিলিক, গুরু গুরু মেঘের গর্জন, চারদিকে ঝি ঝি পােকার ডাক। মন মুগ্ধকরা এ এক মােহময় পরিবেশ।.এহেন বর্ষণমুখর দিনের অনুভবের আঘাদ প্রাণ ভরে গ্রহণ করা যায় মনের মণিকোঠায়, স্মৃতির বাসরে স্মরণীয় করে রাখা যায়, কিন্তু স্বরূপটিকে ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কবির ভাষায় এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘাের বরিষায়।
ক্রমেই অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে এল। এখন আর কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকারে সব একাকার। কেবল পাশের বাড়ির রহমান মিয়ার , আযানের শব্দ শােনা যায়। মা এসে হারিকেনটি ধরিয়ে দিলেন এবং যাবার সময় ঘরের জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে গেলেন।
বর্ষার উপকারিতাঃ
বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে সমস্ত ময়লা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এসময় তরুলতা, গাছপালা খুব সতেজ হয়ে ওঠে। প্রকৃতিতে দেখা যায় রকমারি ফলের আয়ােজন, বিচিত্র ফুলের সম্ভার। নদীপথের যাতায়াত এবং পরিবহন হয় সহজ-সরল ও প্রশস্ত।
অপকারিতাঃ
বর্ষার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি বর্ষার অপকারিতাও কম নয়। বৃষ্টির পানিতে পল্লির রাস্তাঘাট কাদায় ভরে ওঠে এবং কোনাে কোনাে জায়গা পানিতে ডুবে যায়, চলাচলের অসুবিধা হয়। দিনমজুররা হয় ঘরে আবদ্ধ; তাদের দুঃখের সীমা থাকে না। গরিবের ভাঙা চালা দিয়ে পানি পাড়ে ঘর ভেসে যায়। ময়ুবিজয়ের কেতন উড়িয়ে মেঘের গুরু-গুরু মাদল বালিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ঝরে পড়ে বর্ষা। উত্তর দিক থেকে নেমে আসে মরণঢালা ভয়ংকরী বন্যা। এসময় দূষিত পানি পানের ফলে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় প্রভৃতি রােগ মহামারি আকার ধারণ করে।
বন্যাঃ
বন্যা তেমনি দেশের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণ যেমন বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য। প্রতিবছর বন্যাকবলিত হওয়াও বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্য। কখনাে কখনাে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে জলস্ফীতি দেখা দেয়, সঙ্গে । নদনদীতেও প্লাবন আসে। বর্ষা আর প্লাবনের এই অস্বাভাবিক অবস্থাই বন্যা। প্রতিবছর খালবিল, নদীনালা, পুকুর ডােবা প্লাবিত হয়ে গ্রামের পর গ্রাম ডুবে যায়। এ সমস্যা দূর করতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
বন্যার কারণসমূহঃ
বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী মেঘনা, যমুনা ও পদ্ম সবগুলােরই উৎপত্তিস্থল ভারত। মূলত এ তিন নদীর পানি প্রবাহের পরিমাণের হ্রাস বৃদ্ধির ওপরই বাংলাদেশের বন্যা নির্ভরশীল। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও হিমালয়ের বরফগলা পানির আধিক্য বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের ভূমির উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালুর পরিমাণ বেশি নয় এবং বাংলাদেশ গড়ে সমুদ্রতটের তুলনায় মাত্র ৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তাই এখানকার নদীগুলাের পলি বহন ক্ষমতা খুবই কম। ফলে প্রতিবছর নদীবক্ষে পলি জমাট হয়ে নদীর গভীরতা কমে যায়। ক্রমবর্ধমান মানুষ সমস্ত নিচু জায়গা ভরাট করে তাতে তৈরি করেছে শহর, নগর ও নতুন নতুন ঘরবাড়ি। ফলে পানিপ্রবাহের অনেক পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই প্রকৃতিও এর প্রতিশােধ নিচ্ছে বন্যার সৃষ্টি করে। যে বন্যা ছিল স্বাভাবিক, সে বন্যা এখন হয়ে পড়েছে অস্বাভাবিক, নিষ্ঠুর ও নিয়ন্ত্রণাতীত।
উপসংহারঃ
বর্ষায় বাংলাদেশ যেন রূপ-বৈচিত্র্যে তুলনাহীন। বর্ষাকাল বাঙালির প্রাণের ঋতু। ভালােবাসার উষ্ণ স্পর্শে তা সজীব। মানষের মনে সঞ্চার করে অনন্ত বিরহ-বেদনা। মনকে দেয় চির সৌন্দর্যলােকের আভাস। বর্ষাঋতুর প্রভাবকে কোনােক্রমেই অস্বীকার করার উপায় নেই। যদি বর্ষা না আসতাে, তাহলে আমাদের এ দেশ মরুভূমিতে পরিণত হতাে। বর্ষার কারণেই এদেশ সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। বাংলাদেশের এ যে অপরূপ প্রাকৃতিক নিসর্গতা বর্ষারই অবদান। বর্ষার এক হাতে বরাভয়, অন্য হাতে ধ্বংসের প্রলয়-ডমরু। এক পদপাতে সৃজনের প্রাচুর্য, অন্য পদপাতে ধ্বংসের তাণ্ডব। একচোখে অশ্রু, অন্য চোখে হাসি। বর্ষা তাই, আমাদের কাছে চির আদরের ঋতু, অনন্ত বেদনার ঋতু।