ফৌজদারি মামলা কাকে বলে?
এক কথায় চুরি, ডাকাতি, খুন, জখম, প্রতারণা, দস্যুতা, লুটপাট, বিস্ফোরণ, ধর্ষণ, অপহরণ, বেআইনি সমাবেশ, যৌন হয়রানি, জালিয়াতি, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান প্রভৃতি অপরাধে যেসব মামলা দায়ের করা হয় তাকে ফৌজদারি মামলা বলা হয়। এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে জেল জরিমানা, যাবজ্জীবন এবং মৃত্যুদণ্ড হয়ে থাকে।
ফৌজদারি মামলার প্রকারভেদ
সাধারণত ফৌজদারী মামলাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়, একটি আমলযোগ্য মামলা এবং অন্যটি আমল অযোগ্য মামলা। আবার আমলযোগ্য মামলাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়, একটি জি আর বা পুলিশী মামলা অন্যটি সি আর বা নালিশী মামলা।
১) আমলযোগ্য মামলা:
আইন মোতাবেক কিছু অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন। এসব অপরাধে যে মামলা হয় তাই আমলযোগ্য মামলা। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪(১) উপধারায় ক্লজ চ-এ আমলযোগ্য মামলা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
২) আমল অযোগ্য মামলা:
কিছু অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার করতে পারে না। অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে প্রসিকিউশন রিপোর্ট বা নন-এফআইআর মামলা আদালতে দাখিল করে। এগুলো আমল অযোগ্য মামলা। এধরনের অপরাধের মামলা কোর্টের নন-জিআর রেজিস্টার ভুক্ত হয়ে পরিচালিত হয় হয় বলে এ মামলাকে নন-জিআর মামলা বলা হয়। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪ (১) উপধারার ক্লজ ঢ-এ আমল অযোগ্য মামলা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
I) নালিশী বা সিআর মামলা:
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সরাসরি গিয়েও কোর্ট ফি দিয়ে বিচার প্রার্থনা করা যায়। এক্ষেত্রে কা:বি: ২০০ ধারায় শপথ নিয়ে আবেদনের উল্টো পিঠে জবানবন্দি রেকর্ড করতে হয়। কোর্ট রেজিস্টারে মামলা এন্ট্রি হয়ে পরিচালিত হওয়ার কারণে এগুলোকে সিআর মামলা বলা হয়।
II) পুলিশী মামলা:
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে এজাহার দায়েরের মাধ্যমে যে মামলা শুরু হয় তাই পুলিশী মামলা নামে পরিচিত। পুলিশী মামলাকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা হয়:
ক) জি আর মামলা:
থানায় কোন আমলযোগ্য অপরাধ ঘটার খবর পেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কা:বি: ১৫৪ ধারা অনুসারে মামলা করে আদালতে এফআইআর দাখিল করে কা:বি: ১৫৬ ধারা অনুসারে মালার তদন্ত শুরু করেন। এটিই জি আর মামলা। থানা থেকে এফআইআর আদালতে আসার পর কোর্ট ইন্সপেক্টর/সাব-ইন্সপেক্টর বা জিআরও (জেনারেল রেজিস্টার অফিসার) উক্ত এফআইআর-টি মামলা হিসেবে কোর্টের জেনারেল রেজিস্টারে এন্ট্রি করে তা দ্রুত ম্যাজিস্ট্রেট এর নজরে আনেন।
খ) নন জি আর মামলা:
আবার থানায় আমলযোগ্য মামলা সংঘটিত হওয়ার সংবাদ পেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেটিকে এজাহার হিসেবে গণ্য না করে পুলিশ প্রবিধান এর প্রবিধি ৩৭৭ অনুসারে জিডি এন্ট্রি করে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে আদালতে নন-এফআইআর প্রসিকিউশন রিপোর্ট দায়ের করতে পারেন।
ফৌজদারি মামলার ধাপঃ
একটি ফৌজদারী মোকদ্দমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিচার প্রকৃয়া পরিচালিত হয় ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এই আইন দ্বারা ।এই আইনের মধ্যে ৫৬৫ টি ধারা ও ৫টি তফসিল আছে । বিভিন্ন সময়ে সংশোধীত হয়ে বর্তমানে এই আইনে ৪৭৩ টি ধারা ও ৪ টি তফসিল কার্যকর আছে ।সর্বশেষ ২০১২ সালে ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধন হয়েছে । Criminal proceeding এর মধ্যে ফৌজদারী মোকদ্দমার বিভিন্ন ধাপ/স্তর সমুহ সংক্ষিপ্ত ভাবে নিম্নে ধারাবাহিক আলোচনা করা হল :—
১)মোকদ্দমা দায়ের :—
ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয় দুইটি স্হানে যথা :- সংগঠিত অপরাধের এখতিয়ারভুক্ত থানায় এবং এখতিয়ারভুক্ত আদালতে ।
২)গঠনার তদন্ত :—
ফৌজদারী মোকদ্দমায় পুলিশ অফিসার গঠনার সত্যতা যাচাইকরনের জন্য তদন্ত শুরু করবেন ।পুলিশ আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেএে আদালতের আদেশে ব্যতিত এবং আমলঅযোগ্য অপরাধের ক্ষেএে আদালতের আদেশে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন ।
৩) অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন :—
পুলিশ অফিসার তদন্ত সাপেক্ষে অভিযোগের সত্যতা প্রাপ্ত হইলে আদালতে অভিযোগ পএ(Chargesheet) দাখিল করবেন ।অন্যতাই ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করবেন ।অভিযোগের শুনানীর সময় আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তাহার বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ গঠন হচ্ছে জানাবেন ।অভিযুক্ত ব্যক্তি তাহার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের দোষ স্বীকার কিংবা নিজেকে নির্দোষ দাবী করতে পারেন ।
৪) সাক্ষ্যগ্রহন :—
অভিযুক্ত ব্যক্তির উপর গঠিত অভিযোগ প্রমানের জন্য বাদীপক্ষ আদালতে প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য উপস্হাপন করবেন ।বাদী পক্ষে আনিত সাক্ষীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির নিযুক্ত আইনজীবী জেরা করবেন ।
৫)আসামির পরীক্ষা (CRPC-342)
অভিযুক্ত ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমানের জন্য সাক্ষী উপস্হাপন করতে পারবেন ।তাছাড়াও অভিযুক্ত ব্যক্তি দালিলিক সাক্ষ্য ও আদালতে উপস্হাপন করতে পারেন ।
৬)যুক্তির্তক শুনানী :-
বাদীর নিযুক্ত আইনজীবী ও অভিযুক্ত ব্যক্তির নিযুক্ত আইনজীবীগন নিজ নিজ পক্ষে আদালতে যুক্তি উপস্হাপন করবেন ।যুক্তির্তক শেষে আদালত মোকদ্দমার রায় প্রচারের জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করবেন ।
৭) রায় প্রচার :—
বাদী ও অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষের সাক্ষীগনের জবানবন্ধী,জেরা,নথির কাগজপত্র পর্যালোচনা সাপেক্ষে আদালতের নিকট সন্দেহাতীত ভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমানিত হলে আইনানুক শাস্তি প্রদান করবেন ।অন্যদিকে অভিযোগ প্রমানিত না হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আদালত খালাস প্রদান করবেন ।
৮) আপিল দায়ের :—
আদালতের রায়ে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি আইনুসারে ক্ষেএ বিশেষ উচ্চতর আদালতে আইন দ্বারা নিধারিত সময়ের মধ্যে আপিল দায়ের করতে পারেন ।
৯) আপিল নিষ্পত্তি:—
আপিল আদালত শুনানী অন্তে বিচার আদালতের রায় বহাল কিংবা বাতিল করতে পারেন ।বিচার আদালতের রায় আপিল আদালত কর্তৃক খারিজ হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে ।
শেষ কথাঃ
প্রতিটি দেশে অপরাধ করলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে। অপরাধ যা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর ও লজ্জাজনক কাজ।কিন্তু প্রতিটি দেশে শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও মানুষ দিনের পর দিন অপরাধ করেই চলেছে।ফৌদজদারি মামলায় প্রতিটি অপরাধের জন্য শাস্তির ধারা রয়েছে।অপরাধ অনুযায়ী সেই ধরায় শাস্তি প্রদান করা হয়,বা বিচার কাজ সম্পুর্ন করা হয়।