স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে শুরু হলেও বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম যুগ যুগ ধরে চলে। অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত ও অগণিত মায়ের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন শোকের মতোই মর্মান্তিক, অন্যদিকে ত্যাগের মহিমায় গৌরবময় ও বীরত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিঃ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পলাশীর প্রান্তরে এক ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হন। সেখান থেকেই অস্ত যায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। বাঙালি জাতি বৃটিশ শাসনের অধীনে আসে। তারা দুইশ বছর রাজত্ব করেছে। বাঙালি জাতি বিদেশি শাসন, অত্যাচার, বঞ্চনা ও নিপীড়নের দায়ে পিষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আর মনের কোণে লালিত ধূলিকণা- বিভিন্ন সময়ে এদেশের মানুষের মনে জন্ম নেওয়া বিকৃত স্বপ্ন থেকে।
পূর্ব ও পশ্চিম:
পাকিস্তান উভয়েই তাদের ধর্মের কারণে ঐক্যবদ্ধ ছিল ইসলাম। পশ্চিম পাকিস্তানে ৯৭ ভাগ মুসলমান এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের ছিল ৮৫ভাগ মুসলমান। যাইহোক, বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাদের পক্ষে লড়াই করতে বাধ্য করেছিল স্বাধীনতা অর্জনে।
পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ ছিল: পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত। পঞ্চম প্রদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। প্রদেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা অবস্থায়, পশ্চিমের চেয়ে বেশি সম্পদ ব্যবহার করেছে
স্বাধীনতা আন্দোলনঃ
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়েছে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালে উর্দুকে আবার রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হলে ছাত্র-জনতা আবার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ১৯৫২ সালে ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা চাই’ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। আন্দোলন দমন করতে গুলি চালানো হয়। সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরও অনেকে শহীদ হন। 1954 সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পতন এবং যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতার ডাকঃ
১৯৬৯ সালে গনঅভুথানের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন এইদেশকে স্বাধীন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এই দেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে।তাই ১৯৭১ সালে ৭ ই মার্চ বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন।
এই ভাষণ ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নামে পরিচিত। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনগণকে তাদের যা কিছু আছে তাই দিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরার আদেশ দেন। সেই ভাষণই ছিল দেশ স্বাধীনের মূল প্রেরণা। সেই ভাষণেই ছিল যুদ্ধের সকল নির্দেশনা।তিনি বলেন-
"রক্ত যখন দিয়েছি,রক্ত আরো দেবো,এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
মুক্তি যুদ্ধের চেতনাঃ
মুক্তি যুদ্ধের চেতনা বাঙালির শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি প্রদান করেছে।ধর্মীয় গোরামি এবং কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে শত বছরের বাঙালির পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
এই ঐক্য দেশ গঠনে এবং উন্নয়নে বাঙালি জাতিকে এক নতুন উদ্যম প্রদান করে। দেশ প্রেম এবং জাতির সঙাত একত্রে অত্যাবশ্যক। মুক্তি যুদ্ধের চেতনাই পরে আমাদের সব বিভেদ ভুলে দেশ প্রেমিক বাঙালি হিসেবে লাল-সবুজ পতাকার তলে সমাবেশ করতে।তাই মুক্তি যুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়া আজ অপরিহার্য হয়ে পরেছে।
মুক্তিবাহিনী গঠনঃ
মুক্তিবাহিনী বা মুক্তিফৌজ হল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া বাঙালি সেনা, ছাত্র ও সাধারণ জনতার সমন্বয়ে গঠিত একটি সামরিক বাহিনী। ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ধীরে ধীরে সাধারণ বাঙ্গালীদের এই বাহিনী গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্যরা "বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী" গঠন করেন এবং জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী প্রধান সেনাপতি পদ গ্রহণ করেন। এই সময় ভারত বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। সাধারণ জনতা যুদ্ধকালীন সময়ে নিরলসভাবে এই বাহিনীকে সাহায্য করে। যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বাংলাদেশের সকল সেনা ও জনতার বাহিনীকে "মুক্তিবাহিনী" হিসেবে সম্বোধন করা হয়। মুক্তিবাহিনী বেশিরভাগ সময়ই গেরিলা যুদ্ধের নীতি অবলম্বন করে শত্রু পক্ষকে ব্যাতিব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করতো। মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধকৌশল অনেকটা বিপ্লবী চে গুয়েভারার দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো বলে মনে করা হয় এবং একে বিভিন্ন সময় ফরাসি মাকি বাহিনী, ভিয়েত কং এবং মার্শাল টিটোর গেরিলা বাহিনীর তুলনা করা হতো এর রণকৌশল ও কার্যকারীতার কারণে।
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানঃ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধপূর্ব প্রেক্ষাপট ও ঘটনাপ্রবাহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই সংগ্রাম পরিণতি অর্জন করেছে কয়েকটি ধাপে- যার প্রতিটি ধাপে রয়েছে এদেশের নারীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও আত্মত্যাগ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম দুটি নক্ষত্র প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরী- বাংলাদেশের নারীদের রয়েছে সাহসী সংগ্রাম, যুদ্ধ ও আত্মদানের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে নারী-পুরুষ সকলেই সর্বাত্মক ও সমানভাবে এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রির গণহত্যার পর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী যখন পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে, সেই সময় ঢাকাসহ সারাদেশেই সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন। বিপন্ন নারী-পুরুষ ও শিশুর দল গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ছাড়িয়ে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা ছাড়াও নারীর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে বাছবিচারহীনভাবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যদিও বাংলাদেশ সরকারের নীতিতে নারীদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া, গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং প্রশাসনিক কাজের নেতৃত্বদানের দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তারপরেও এক্ষেত্রে নারীরা ছিলেন অগ্রগামী। কলকাতায় মুক্তযুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় গোবরা ক্যাম্পে ৩০০ তরুণীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। গোবরা ক্যাম্পে নারীদের তিন রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো- সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং এবং অস্ত্রচালনা ও গেরিলা আক্রমণ। যদিও অস্ত্রচালনা শেখার পরও তাঁদেরকে সম্মুখসমরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি, তারপরও স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী, যেমন – ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা, আলেয়া বেগম। বরিশালের করুণা বেগম ছিলেন অকুতোভয় মুক্তিসেনা। আলমতাজ বেগম ছবি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। পথে-প্রান্তরে অলিগলিতে গান গেয়ে তাঁরা অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ব্যয় করেছেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে গান শুনিয়ে তাঁদের উদ্দীপনা জুগিয়েছেন শিল্পীরা।
আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা দিয়েছেন।
মূলত এভাবেই নানামুখী ভূমিকা নিয়ে নারীরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ছিলেন অদম্য। তাঁরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন, অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাঁদের জন্য ওষুধ, খাবার এবং কাপড় সংগ্রহ করা- রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাঁদের মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নারীদের এই বহুমাত্রিক ভূমিকা ও আত্মত্যাগ বুঝতে ও মূল্যায়ন করতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান – সব ধর্মের নারীই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কেবল বাঙালি নয়, সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আদিবাসী নারীরাও। যুদ্ধকালে যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছেন, তাঁদের ও তাঁদের গর্ভজাত যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন ছিল, স্বামীহারা বিধবাদের দরকার ছিল আশ্রয়। এসবই তখন বড় করে দেখা হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৭১-এর নারী নির্যাতনকে বীরত্বের মহিমা দিয়ে মহিমান্বিত করার জন্য তাঁদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের সর্বত্র যে বিপুল সংখ্যক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, নিগৃহীত হয়েছেন, তা কেবল তাঁরা নারী বলেই। পুরুষেরা যখন সংগ্রামরত ছিলেন পাকিস্তানি সৈনিকদের পরাস্ত করে স্বদেশকে মুক্ত করার জন্য, নারীকে তখন দেশমুক্তির পাশাপাশি নিজের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। নারীদের জন্য এটা এক ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ, তাঁর শরীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ; আর সেটা বুঝতে সময় লেগেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবারই। বলার অপেক্ষা রাখে না, মুক্তিযুদ্ধকালে নারীর আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত সনাতন ও পশ্চাৎপদ।
ভারতের সাহায্য ও স্বীকৃতিঃ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ জনগণ তাদের সহানুভূতি এবং সমর্থন বেশ জোরালোভাবে প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসাসহ সার্বিক সহযোগিতা করেছিল ভারত সরকার, তার জনগণ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, বিশ^জনমত গড়ে তোলাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছিল। ভারতের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষাবিদ, শিল্পীদের মধ্যে প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ১০ দিন আগে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতাকে আমরা কয়েক প্রকারে বলতে পারি। প্রথমত, ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশীদের আশ্রয় প্রদান। তাদের জন্য খাদ্য, ওষুধ সরবরাহ ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, যুব শিবির স্থাপনে সাহায্য ও মুজিববাহিনীতে অংশগ্রহণকারী যুবকদের প্রাাথমিক শিবির ও প্রশিক্ষণ। তৃতীয়ত, নিয়মিত বাহিনী অর্থাৎ সেক্টর কমান্ডার সেনাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, রসদসহ সর্বপ্রকার সাহায্য।
গৌরবময় বিজয়ঃ
ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪:৩১ মিনিটে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ সংগ্রামে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজি ৯৩,০০০ সৈন্যসহ বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরেরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ নথিতে স্বাক্ষর করেন। ফলে দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রামের অবসান ঘটে এবং বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় লাল-সবুজ পতাকার একটি স্বাধীন সার্বভৌম।
দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রামের পর ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও সহায়-সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বাঙালি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি দেশের এক-একটা এলাকায় ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছিলো। দেশবাসীর মধ্যে বিজয়ের উচ্ছ্বাস-আনন্দ, প্রিয়জনের ফিরে আসার প্রতীক্ষা, ধ্বংসস্তুপ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর স্বজন হরানোর শোকের ভেতরও এক পুলকিত স্বস্থির আবহ বিরাজ করেছিলো সেই দিনটিতে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) জেলা সংবাদদাতাগণ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন, তাদের জেলায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি কিভাবে ধরা দিয়েছিলো, কেমন ছিলো সেই দিনটি, তারা মুখোমুখি হয়েছেন সেদিনের রণাঙ্গণ ফেরৎ স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আর প্রতক্ষ্যদর্শীদের কাছে।
মানবিক মূল্যবোধ কি?
মানবিক মূল্যবােধ হচ্ছে শৃঙ্খল ও ন্যায় সমাজ গঠনের প্রথম শর্ত। মানবিক মূল্যবােধ বলতে কতগুলাে মনােভাবের সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বিশ্বাসকে বুঝায়। যে চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষের মানবিক আচরণ, ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাই মানবিক মূল্যবোধ। ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও শিষ্টাচার মানবিক মূল্যবােধের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। বড়দের সম্মান করা, আর্তের সেবা করা, উত্তম ব্যবহার, সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা প্রভৃতি মানবিক মূল্যবােধের উদাহরণ। মানবিক মূল্যবােধ ব্যক্তির মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। আর এভাবে ব্যক্তিসত্তা বিকাশ করে এটি সুশাসনের পথকে প্রশস্ত করে এবং সামাজিক অবক্ষয়ের অবসান ঘটায়। পরিবার, বিদ্যালয়, সম্প্রদায়, খেলার সাথী, সমাজ ও প্রথা থেকে একজন শিশু মূল্যবােধ লাভ করে। এ নিয়ামকগুলাে মানবিক মূল্যবােধ গঠনেরও প্রধান মানদন্ড। মূলত যেসব বিষয় একমাত্র মানুষের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি হওয়ার যােগ্য তাই মানবিক মূল্যবােধ। এ মানবিক মূল্যবোধ লালিত করার ফলে সময়ের সাথে আদর্শিক, ধর্মীয় বা পবিত্র বিষয়গুলাে জাগ্রত হয়। আবেগি ও আদর্শগত ঐক্যের ধারণার মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিকভাবে একজন মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবােধ ফুটে ওঠে, যা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে সুশৃঙ্খল ও উন্নত করে।
স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধঃ
স্বাধীনতা থাকে মন ও হৃদয়ে। মানুষ একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবনযাপন করার স্বাধীনতা চায়, স্বাধীনভাবে এমন একটি জীবনধারা নির্বাচন করার স্বাধীনতা চায় যেখানে তারা এবং তাদের সন্তানরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং তাদের হাত, মাথা এবং হৃদয়ের কাজের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করতে পারে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এদেশের ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও জনগণের লাল স্মৃতি জড়িয়ে আছে। লাখো শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তাদের কথা স্মরণ না করে আমাদের তাদের মতামতে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য প্রতিফলিত হবে।