বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ |
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ রচনা
ভূমিকাঃ ❝হে বঙ্গবন্ধু, তোমার কালো ফ্রেমের চশমাটা আমায় দাও,আমি চোখে দিয়ে দেখবো, তুমি কেমন করে দেশটাকে এতো ভালবাসো।❞
পৃথিবীতে কোনো দেশ যখনি কোনো সংকটে পরেছে তখনই জন্ম হয়েছে কোনো না কোনো কোনো মহাপুরুষের।বাংলাদেশে ও জন্ম হয়েছিল এক মহান নেতার।
‘বাংলাদেশ’ নামটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরাধীনতার শেকল থেকে এ দেশকে, এ জাতিকে মুক্ত করতে যিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু না হলে হয়তো আজকের এ বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না। আমরা পেতাম না স্বাধীন বাংলার মুক্ত বাতাস, পেতাম না একটি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিটি ধাপে অগ্রণী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তারই নেতৃত্বে।
যুগ যুগ ধরে বাংলার বুকে আক্রমণ করেছে বহু হানাদার বাহিনী। ইউরোপিয়ান বণিক, পর্তুগিজ, ইংরেজ থেকে শুরু করে বহু জাতি বহু বার এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে পড়ে এদেশের মানুষকে শাসন ও শোষণ করেছে। সর্বশেষ তদানীন্তর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এদেশের মানুষের অধিকার কেড়ে নিলে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। তাই বাংলাদেশের কথা বললেই বলতে হয় বঙ্গবন্ধুর নাম।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম পরিচয়ঃ
শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ (৩ রা চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফুর রহমান, মাতা সায়েরা খাতুন। শেখ মুজিব, তাঁর পিত-মাতার তৃতীয় সন্তান।
শেখ মুজিবুর রহমানের নাম রাখেন তাঁর নানা শেখ আবদুল মজিদ। ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম ছিলো ‘খোকা’। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাধারণ মানুষ ও গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি সহমর্মী স্বভাব দেখাতেন।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবনঃ
১৯২৭ সালে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তখন তাঁর বয়স ছিলো ৭ বছর। তিনি গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯২৯ সালে ৯ বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। পিতার সরকারি চাকরিতে বদলিজনিত কারণে তিনি আবারো স্কুল পরিবর্তন করেন। ১৯৩১ সালে মাদারীপুর ইসলামিয়া স্কুলে তিনি ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলেই তিনি ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
১৯৩৪ সালে বেরিবেরি নামক এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন বঙ্গবন্ধু। এতে করে তাঁর হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়ে যায়। তাঁর চোখেও জটিল রোগ ধরা পড়ে ১৯৩৬ সালে। অপারেশনের মাধ্যমে এ রোগ সারাতেও বেশ কিছু সময় লেগে যায়। তাই বেশ কয়েক বছর তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন নি।
সুস্থ হওয়ার পর ১৯৩৮ সালে মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় তিনি গৃহশিক্ষক হিসেবে এক ব্রিটিশবিরোধী সক্রিয় আন্দোলনকারী ও বিপ্লবীর সংস্পর্শ পান। ১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন বঙ্গবন্ধু।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ এবং ১৯৪৭ সালে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। দেশভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন। তবে কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁকে তখন বহিষ্কার করা হয়। ২০১০ সালে সে বহিষ্কার আদেশ তুলে নেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময়। স্কুলের ছাদ সংস্কারের জন্য একটি দল গঠন করে নিজ নেতৃত্বে তিনি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নিকট দাবি পেশ করেন। ১৯৪০ তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে এক বছরের জন্যে যুক্ত হন। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে এনট্র্যান্স পাশ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন।
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) পড়া থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দান করার সুবাধে তিনি বাঙালি মুসলিম নেতা হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে তোলার আন্দোলন নিয়ে তিনি ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার পর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। মুসলিমদের রক্ষা করার জন্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হন। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারির ৪ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।এই রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে দিয়েই বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার বীজ নিহত ছিল।
পাক রাজনৈতিক জীবনঃ
বাংলাদেশের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি শুরু মাত্র নেতা নন,তিনি বিশ্ব রাজনীতি অবিসংবাদিত নেতা। বাংলা ও বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক জীবন শুরু করার আগেই থেকে গ্রামের মানুষের দুঃখ দেখে নিজের ভেতর এক প্রকার কষ্ট অনুভব করতেন ।তিনি ক্ষুধার্তদের মুখে নিজের খাবার তুলে দিয়েছেন । শীত আসলেই শীতার্থদের নিজে চাদর দিয়ে সাহায্য করতেন । তখন থেকেই তিনি ন্যায়ে কথা বলতেন। অন্যায় বা অন্যায় কারী যত শক্তিশালী হোক না কেন তার প্রতিবাদ করতে তিনি বিন্দুমাত্র ভয় পেতেন না । একটা স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতিকে মুক্তি করা তাদেরকে স্বাধীনতা লাভ করে দিয়ে সবার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া।তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাঝেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনঃ
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন আইন পরিষদ এ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিবে বলে ঘোষণা দিলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘোষণার প্রতিবাদ করেন এবং ২ রা মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে এক বৈঠকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলেন ।১১ মার্চ হরতাল চলাকালে তিনি গ্রেফতার হন ।১৯৫২ সালে ছাব্বিশে জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আবার ঘোষণা করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দূ। বন্দী থাকা অবস্থায় এই ঘোষণার প্রতিবাদ করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি রাজবন্দিদের মুক্তি এবং বাংলা কি রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ঢাকার রাজপথে ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিল বের করলে ওই মিছিলে পুলিশের গুলিতে অনেকে শহীদ হন । এরপর তিনি ২৬ শে ফেব্রুয়ারি জেলখানা থেকে মুক্তি লাভ করেন।
৬ দফা দাবিঃ
১৯৬৬ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানি সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী দিয়ে ও অন্যান্য ৩৫ জন সেনা ও কর্মকর্তার৷ বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করেন।পরে ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করা হয় ঢাকা সেনানিবাসে।বঙ্গবন্ধু এই ৬ দফা দাবি ছিল তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে।
গনঅভ্যুত্থানঃ
১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ৬ দফা সহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে 'কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদগঠিত হয়।এই পরিষদে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে এই আন্দোলন গনঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রিক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কে "বঙ্গবন্ধু "উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
সােনার বাংলা গড়ার গােড়াপত্তনঃ
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনে-প্রাণে বাঙালি। শৈশবেই বঙ্গবন্ধুর মানস-চেতনায় বাঙালি জাতির শৃঙ্খলমুক্তির আকাঙ্খ এবং রাজনৈতিক চেতনার বীজ প্রােথিত হয়েছিল। গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলন কিশাের মুজিবের মানসচেতনায় রােপণ করেছিল বাঙালিয়ানার বীজ। ১৯৩৯ সালে গােপালঞ্জ মিশনারীর স্কুলে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তির পর তিনি এ আন্দোলনে যুক্ত হন। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনকে বেগবান করতে ও বাঙালির মধ্যে জ্ঞান, শ্রম, একতা ও দেশপ্রেমের দীক্ষাদানের জন্য ১৯৩১ সালে গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের সূচনা করেন। গুরুসদয় দত্তের বাঙালিয়ানার মন্ত্র –
ষােলাে আনা বাঙালি হ’
বিশ্ব মানব হবি
যদি শাশ্বত বাঙালি হ’
শােণিতে ধারণ করেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি । ব্রতচারী আন্দোলনের স্বদেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা হৃদয়ে লালন করেই শেখ মুজিব সােনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবদানঃ
১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তান সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষামতা হস্তান্তর করতে নানা প্রকার তাল বাহানা শুরু করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে সর্ববৃহৎ জনসভায় ঘোষণা করেন -
"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।জয় বাংলা "
তার এই ৭ই মার্চের ভাষনে হাজার হাজার মানুষের মনে এক নতুন স্বপ্ন এব নতুন স্বাধীন দেশের অনুভব করিয়েছিল। এবং তা অর্জন করার জন্য দেশের সকল শ্রেণীর সকল পেশার নারী,পুরুষ, ছাত্র শিক্ষক,শ্রমিক এগিয়ে এসেছিল।ঐক্য বদ্ধ হয়েছিল সকলেই। এই ধারাবাহিকতায় ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট নামে ঘুমন্ত বাঙালির উপর হামলা চালায়।এরকম অবস্থায় ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।এর পর তাকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। আর শুরু হয়ে যায় মুক্তির জন্য সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পনের অর্জিত হয়েছে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।পরে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশঃ
বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সুস্থ, সবল জ্ঞান, চেতনা সমৃদ্ধ, কোনরকম ভেদ বৈষম্যহীন, শােষণহীন, অসাম্প্রদায়িক, চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক মানুষের উন্নত সমৃদ্ধ এক আধুনিক বাংলাদেশের।তার স্বপ্নের দেশে কোনো মানুষ না খেয়ে থাকবে না,কেউ দরিদ্র থাকবে না,জ্ঞান হীন,কর্মহীন কোনো ব্যক্তি থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করা যায় এভাবে, সব মানুষের জন্য পাঁচ ধরনের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। এর মধ্যে থাকবে
- ১.রাজনৈতিক স্বাধীনতা,
- ২.অর্থনৈতিক সুযােগ,
৩.সামাজিক সুবিধাদি স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা এবং ৪.ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সুরক্ষার স্বাধীনতা। আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম দর্শন ছিল বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও সমাজ বিনির্মাণের বিষয়টি ছিল অন্যতম অনুষঙ্গ।তিনি ছোট থেকে দেশের মানুষকে শুধু অবহেলা, নির্যাতিত হতে দেখেছে।বিভিন্ন ভাবে বৈষম্যের শিকার হতে দেখেছে।তাই তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে ছিল না কোনো বৈষম্য, থাকবে শুধু স্বাধীনতা।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখাঃ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল নতুন দেশ পুনর্গঠনের নীলনকশা ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
❝বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা এবং আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি যদি দেশবাসী খাবার না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে পূর্ণ হবে না। ❞
স্বাধীন দেশের আর্থ সামাজিক চরিত্রের পাশাপাশি আদর্শিক ভিত্তিটিও নির্দেশিত হয়েছিল এমনভাবে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনাে ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা (পরবর্তীকালে সংযােজিত হয়েছিল জাতীয়তাবাদ)।
স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুঃ
১৯৭২ সালের গােড়ায় যে দেশটি স্বীকৃতি ও বান্ধবহীন ছিল, সে দেশটি ২ বছরের মধ্যে ১৯৭৪ এর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব অগ্রগতির পথে নিয়ে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তা আলোচনা করা হলো :
- ১.সােভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে চট্টগ্রাম আর মংলা বন্দরের মাইন অপসারণ করে বন্দরকে পুনরায় ব্যবহারযােগ্য করে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে সচল করে তুলেছিলেন খুব কম সময়ের মধ্যে।
- ২.দেশের ৫৮০টি শিল্পকারখানাসহ পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সব সম্পদ জাতীয়করণ।
- ৩.হাজার হাজার শ্রমিককর্মচারীদের কর্মসংস্থান।
- ৪.মাদ্রাসা বাের্ডের পুনর্গঠনসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট স্থাপন।
- ৫.দেশের কৃষক শ্রেণি ও কৃষিব্যবস্থার ভাগ্য পরিবর্তন ও আমূল সংস্কারের জন্য স্বাধীনতা লাভের পরপরই ৩৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে-নামমাত্র মূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
- ৬.বঙ্গবন্ধু আধুনিক বিজ্ঞান ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন।
- ৭.স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করেন।
বঙ্গবন্ধুর কিছু মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল, স্বনির্ভরতা অর্জন, দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণ ও ব্যবহার করা যা হতে হবে শর্তবিহীন এবং ক্রমে এ নির্ভরতার অংশ কমিয়ে আনতে হবে। বেসরকারি খাতকেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও শিল্পায়নে সম্পৃক্ত করা। স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলাের উন্নয়ন, জাতীয় জীবনে নারীদের অংশগ্রহণ। আজকের বাংলাদেশের যে সমৃদ্ধি, উন্নয়নের মহাসােপানে যে অভিযাত্রা তার সূচনা করেছিলেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডঃ
বাংলাদেশের বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হয়। দেশে ফেরার পর ১২ই জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনভার গ্রহন করেন। এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তােলার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন।তিনি যখন তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনি পরাজিত হায়েনার দল তার সাফল্য ও বাঙালির উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। তাই আবার শুরু হয় ষড়যন্ত্র। দেশ যখন সকল বাধা দূর করে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী ও আন্তর্জাতিক চক্রের শিকারে পরিণত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর তৎকালীন কিছু উচ্চাভিলাষী ও বিপথগামী সৈনিকের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। তাই বাঙালি জাতি প্রতিবছর ১৫ ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন করে।
স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু কন্যাঃ
স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকদূর এগিয়েছে। অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা স্থিতিশীলতায় আসার পর এখন শুরু হয়েছে মৌলিক কাঠামােগত পরিবর্তন। কেননা বঙ্গবন্ধুর পরে এবার তার সুযগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা তার বাবার স্বপ্ন পুরন করার জন্য দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করার জন্য এগিয়ে আসেন।তাই আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের দিকে। ফলে অর্থনীতির সূচকগুলাের পাশাপাশি সামাজিক সূচকেও মৌলিক পরিবর্তন আসছে। শিল্প ব্যবসাবাণিজ্য, ব্যাংক-বিমা, বিভিন্ন সেবা খাত, যােগাযােগ ব্যবস্থায় এসেছে যুগােপযােগী ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা। বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলিক রূপান্তর আজ গােটা | বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। যে বাংলাদেশকে এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়ে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিল আন্তর্জাতিক একটি মহল, তারাও আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিস্ময় প্রকাশ করছে, প্রশংসা করছে। সম্প্রতি নিজ অর্থায়নে তৈরি হয়েছে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম সেতু “পদ্মা সেতু”।এর পরে তৈরী করা হচ্ছে কর্নফুলি টানেল।যা আমাদের দেশ ও জনগণের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। এরফলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে তার ভাবমূর্তিকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য যােগ্য নেতৃত্বদানকারী অসাধারণ এক নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্বের কথা বারবার আলােচিত হচ্ছে।
উপসংহারঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যার নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতাে দীপ্যমান তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর দূরদশী, বিচক্ষণ এবং সঠিক নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক। তিনি মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন বলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নটি সত্য হয়েছিল। রাজনৈতিক-সামাজিক ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়কের এই অবস্থানে উখিত হতে পেরেছিলেন। জেল-জুলুম ও নির্যাতনের কাছে তিনি কখনাে মাথা নত করেননি। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করার শামিল। ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ আজ সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে এক ও অভিন্ন নাম। আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। আসুন সবাই বলে উঠিঃ