মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রচনা |
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রচনা
ভূমিকা:
"মোরা একটি ফুল কে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।
যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদী জল ফুলে ফুলে মোর স্বপ্ন আকা
যে নদীর নীল অম্ব্রে মোর মেলছে পাখা
সারাটি জনম যে মাটির ঘ্রাণে অস্র ধরি।
-গোবিন্দ হালদার
হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। বাঙালির প্রাকৃতিক পরিবেশেই মিশে আছে প্রতিবাদের ভাষা । বিদেশি শক্তির আগ্রাসন এ জাতি কোনােদিনই মেনে নিতে পারেনি। তাই পরদেশি শােষকদের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে বার বার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য আত্মদানের রক্তে বারংবার সিক্ত হয়েছে বাংলার মাটি।অবশেষে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি অর্জন করে প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক সে মুক্তিযুদ্ধ যে বােধ বা চেতনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল তারই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা । ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের প্রেরণা জোগাবে অনন্তকাল।
জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ:
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এমনি এমনি আসেনি। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিরা তাদের অধিকার পাওয়ার জন্য করেছিল।
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের জাতাকলে প্রায় দু’শ বছর ধরে নিষ্পেষিত হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশ । ১৯৪৭ সালে সে নিষ্পেষণ থেকে উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ মুক্তিলাভ করলেও মুক্তি মেলেনি বাঙালি জাতির । ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও পাকিস্তানি শাসকদের শৃঙ্খলে বন্দি হতে হয় বাঙালি জাতিকে। সেসময় বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের সংকীর্ণ মনােভাব ও শােষণ-নিপীড়ন এদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তােলে। এর মধ্য দিয়ে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালি নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এ জাতীয়তাবাদী চেতনার নিরিখেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে সংগ্রাম করে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে বাঙালি।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিঃ
মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীনতা প্রিয়।সবাই বাচতে চায় স্বাধীন ভাবে।তাই স্বাধীনতার জন্য মানুষ যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে আসছে।সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ শুধু স্বাধীন ভাবে বেচে থাকার জন্যই বিভিন্ন যুদ্ধ করে আসছে।তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনেও রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। সেই ১৭৫৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল যুদ্ধ।ইংরেজরা বাংলায় রাজত্ব করার জন্য বাংলার শেষ নবাব সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র মুলক যুদ্ধ করেন,এবং সেই যুদ্ধে সিরাজ উদ-দৌলা কে পরাজিত করে বাংলার অধিকার ছিনিয়ে নেয়।সেইদিন থেকেই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।তারপর বাঙালী প্রায় দুইশত বছর ইংরেজদের অধিনে পরাধিন হয়ে ছিল।ইংরেজদের নিপিড়ীত হয়ে মানুষের মনে জন্ম নেয় স্বাধীনতার চেতনা। এইভাবেই ১৯৪০ সালে এ কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত করে এবং তার মাধ্যমেই প্রথম বাংলাদেশের বীজ বপন হয়।এরই মাধ্যমে ইংরেজরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
তারপর ১৯৪৭ সালে দ্বী-জাতিতত্বের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়।এর মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের। আর বাংলাদেশের মানুষ অনর্ভুক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তানে।পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্গত হলেও স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে নি।কারন পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের হাতে শাসন ক্ষমতা রেখে বাঙালিদের শাসন করতে থাকে।শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসনিক ও সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তারা বৈষম্য শুরু করে।পূর্ব পাকিস্তানিরা সবক্ষেত্রেই হতে থাকে অবহেলিত। ফলে তদের মনে আন্দোলন দানা বাধতে শুরু করে।পশ্চিমারা উর্দু কে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠত করতে গিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে কেরে নিতে চেয়েছিল।
এর ফলেই ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তিম সংগ্রাম। এর পর ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অর্জন হলে এদেশের মানুষ আরও অধিকার সচেতন হয়ে উঠে। ১৯৬৯;সালে দেশে গণঅভুয়ত্থান ঘটে। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।এদিকে ইয়াহিয়া সরকার ক্ষমতা ছাড়তে নানা তালবাহানা শুরু করে।ফলে বাঙালীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আর বাঙালীদের স্বাধীকার চেতনাকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়।এদিকে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গভির রাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায়।এদিকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে।এর পরেই বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। এবং সমগ্র দেশের মানুষ ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যঃ
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের অসহায় মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। তারা এদেশে ভয়াবহ হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল।তাদের এই অত্যাচার নির্যাতন ও জুলুম পেতে স্বাধীন -সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লখ্যে সেদিন এদেশবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।প্রাত্যাশা ছিল যে, নতুন স্বাধীন দেশে সকলের জন্য অবারিত হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা সহ নানা সুযোগ -সুবিধা।একটি শোষণ মুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মুল লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্য।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহঃ
১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণে পাকিস্তানিরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তার ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। তার নির্বিচারে হহত্যাযজ্ঞ চালায় পিলখানা,রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মধ্যে রাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রবতার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই, অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।তার স্বাক্ষরিত ঘোষণা বার্তাটি তৎকালীন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চটচট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়।এরপর চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচার হতে থাকে তার স্বাধীনতার ঘোষণা। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পরে তার মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ১০ ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়।১৭ ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। এমনই ভাবে দদীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরুপঃ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মীয় কুসংস্কার ভুলে গিয়ে বাঙালী হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ,খ্রিস্টান একই পতাকাতলে জড়ো হয়েছিল। বাঙালির আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন প্রেরণা দান করে এই মুক্তিযুদ্ধ।আমাদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধ।বাঙালী জাতির আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার লাভ করে বিশ্বের দরবারে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তাকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
যে অসম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে বাঙালি এগিয়ে চলেছে তার গতি সুস্থিত নয়।মাঝে মাঝে বাঙালি জাতিয় মতানৈক্যের অভাবে সমাজ ও রাষ্টীয় পর্যায়ে নানা অস্থিরতা দেখা দেয়।অন্যকে কিছু গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক চেতনা ও কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত করেছে মূল চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে।লাল সবুজ পতাকাতলে মানুষ কোনো ধর্মীয় চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়নি,বরং সকল ধর্মীয় কুসংস্কার ভেদকরে মানবতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছে।এই মুক্তিযুদ্ধের মুল চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশঃ
১৯৭১ সালে বাংলার মানুষ স্বপ্ন দেখেছে শোষণ -বৈষম্যহীন স্বাধীন -সার্বভৌম পবিত্র ভুমিতে বেচে থাকার এক অদম্য ইচ্ছায় মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে।সকল শ্রেণির মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অধিকার আদায়ের চেতনা হল মুক্তির সংগ্রাম। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র,সাধারণ জনতা সহ সকল পেশার মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছিল। আত্মনির্ভরশীল একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়াই ছিল তাদের মূল চেতনা, প্রেরণা। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছে আমাদের দেশের বীর সন্তানেরা।বাঙালি জাতি শ্রাদ্ধার সাথে তাদের এই অবদানকে মূল্যায়ন করবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও আজকের বাংলাদেশঃ
যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত চার দশকেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর বারবার সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্ব, জনস্ফীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী কার্যকলাপ বারবার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাইরে। প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়ােজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ । এজন্য দুর্নীতিমুক্ত ও কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়ােজন তেমনি প্রয়ােজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাথা আর আত্মত্যাগের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
স্বপ্নের বাংলাদেশ বনাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঃ
প্রকৃত প্রস্তাবে শােষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এদেশের সাধারণ মানুষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থেকে সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তােলার স্বপ্নও তাদের সেদিন তাড়া করেছিল। তবে সে সময়ের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামের প্রত্রিকার ২১ নভেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় বলা হয়েছিল : “স্বাধীন বাংলাদেশের ছবিও সকল শ্রেণীর মানুষের মনে এক রকম নয়। কৃষক ভাবিতেছে স্বাধীন বাংলাদেশে সে জমি পাইবে, সামন্তবাদী শােষণের নাগপাশ হইতে পাইবে মুক্তি। শ্রমিক ভাবিতেছে সে পাইবে বাঁচার মত মজুরি, কাজের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার। যুগ যুগ ধরিয়া সে সভ্যতার পিলসুজ হইয়া কাটাইয়াছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যদিয়া এমন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দুয়ার খুলিয়া যাইবে সেখানে সে সভ্যতার নির্মাতা হিসাবে উহার ফল ভােগেরও অধিকারী হইবে। সকলের অন্ন, বত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয়ের মতাে ন্যূনতম চাহিদাগুলি মিটিবে।”
স্বাধীনতার পর বারবার সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্ব, জনস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ঘুস, দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করে চলেছে। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সভা, সমিতি, বিবৃতিতে বারবার যে কথাটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করেছেন তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার কথা। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী কার্যকলাপ বারবার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাইরে। প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন গত আটত্রিশ বছরে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাঃ
যে স্বপ্ন নিয়ে বাঙালীরা যুদ্ধ করেছিল, স্বাধীন করেছিল দেশকে আসলেই কি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ান হয়েছে? হলেও কতো টুকু কয়েছে?
বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। এ অবক্ষয় যুবসমাজকেও প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। আমাদের যুবসমাজের সামনে আজ কোনাে আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মতন কোনাে মহৎপ্রাণ মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। যুব সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতাে কোনাে পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই আমাদের যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও যুবসমাজের অবক্ষয়ের আর একটি কারণ। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করেছে। তরুণসমাজ অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করে, সমাজে সমাজ-বিরােধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সততা সেখানে লাঞ্ছিত, অসহায়। বিবেক সেখানে বিবর্জিত। জ্ঞানী-গুণীরাও তাদের খাতির করে। রাজনৈতিক নেতাদের তারা ডান হাত। জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজকর্ম করেও তারা আইনের চোখে নিরাপদ। প্রশাসন প্রয়ােজন মতাে ওদের ব্যবহার করে। কী তাদের মূলধন ? তারা অনায়াসে মানুষ খুন করে, ডাকাতি করে, জনজীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই মূলধন নিয়েই ওরা সমাজের বিশিষ্ট মানুষ।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন চরম অবনতি ঘটেছে। কৃষকরা পাচ্ছে না ন্যায্য মূল্য,কিন্তু বাজারে দ্রব্য মুল্য বৃদ্ধির কারনে দরিদ্র মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকে না। আর রাজনৈতিক অবস্থাতেও চলছে দূর্নীতি।বাড়ছে ঘুষ,গুম,হত্যা, রাহাজানি। কোথায় গেলো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ। যেখানে কৃষকরা বঞ্চিত,দেশের মানুষ লাঞ্চিত।
বাংলা সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঃ
বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবচেয়ে বেশি প্রতিফলনও হয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের করুন কাহীনি ও বীরত্বগাথা দিয়ে রচিত হয়ে,গল্প,উপন্যাস, নাটক, সংগীত,প্রবন্ধ,এবং অসংখ্য কবিতা ও ছড়া।মাহাববুল আলমের ভাষায়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যথেষ্ট প্রতিফলন রয়েছে।স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভুমিতে এখনকার জীবনে যেসকল আলোড়ন তৈরি হয়েছে তার প্রত্যক্ষদর্শী ঔপন্যাসিকগন উপেক্ষা করতে পারে নি।তাই এখনকার ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রাঙ্কনের সাথে সাথে যুদ্ধসময়ের ঘটনা গুলো তুলে ধরা হয়েছে। শওকত ওসমানের "দুই সৈনিক" সৈয়দ শামসুল হকের "নীলা দংসন",রাবেয়া খাতুনের "মুক্তিযুদ্ধার স্ত্রী",আনোয়ার পাশার " রাইফেল রোটি আওরাত",রাজিয়া রহমানের "রক্তের অক্ষর ",সেলিনা হোসেনের " হাঙর নদীর গ্রেনেড",ইমদাদুল হক মিলনের "মুক্তিযুদ্ধ ",শিরিন মজীদের " অপু বিজয় দেখেনি"প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। এরকম অনেক গল্প, অনেক উপন্যাস নিয়ে তৈরী হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। যা বর্তমানে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের কথা, ও ভয়াবহ কাহিনী গুলো জানতে পারবে।
উপসংহার:
"স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামের উদার জমিন"
-শামসুর রহমান
স্বাধীনতা যে মানুষের জন্মগত অধিকার, বাংলাদেশের মানুষ তা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম এই স্বাধীনতা। এর মাধ্যমে অবসান ঘটেছিল পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছরের শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের। তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা এখনো বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা গড়তে পারিনি। স্বাধীন জাতি হয়েও স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ এখনো আমরা পাইনি। তাই সকল সংকটকে দূরে ঠেলে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিজেরদেরকে দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ, ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই আমরা রক্ষা করতে পারব আমাদের স্বাধীনতাকে।