শহীদ মিনার । রচনা ও বাংলা প্রবন্ধ

শহীদ মিনার । রচনা ও বাংলা প্রবন্ধ
শহীদ মিনার রচনা 

ভুমিকাঃ

❝আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি 
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ❞

২১ শে ফেব্রুয়ারি সাঝ সকালে হাতে ফুল নিয়ে খালি পায়ে আমরা পিলপিল করে এগিয়ে যাই শহীদ মিনারের সামনে শহীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।তাদের এই আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা কে আমরা ঠিক কতটা ভালোবাসি।মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করগে গিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা রাজপথে তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিল।সন্তান হারা হয়েছিল অনেক মা।সেই মায়ের বীর সন্তানদের স্মৃতি হিসেবে গড়ে তোলা হয় এই শহীদ মিনার।যা আমাদের দেশের গৌরবের বিষয়।

শহীদ মিনার তৈরির পটভূমিঃ

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়।এই দেশ বিভাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম এর।ভারত স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্তান পুরো পুরি স্বাধীনতা লাভ করতে পারে নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে ছিল দুইটি ভাগ।পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান।পূর্ব পাকিস্তান তখন প্রাদেশিক মর্যাদায় পূর্ব পাকিস্তান নামে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই শাসন ক্ষমা দখল করে পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালী শাসকগুষ্টি।তখন থেকেই বাঙালির মাতৃভাষা  বাংলা নিয়ে চক্রান্ত শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিলেন-

    "Urdu and Urdu shall be the state language Pakistan "

কিন্তু বাঙালীরা সেটা কিছুতেই মানতে রাজি হয়নি।বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে শুরু হয় ভাষা  আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন নিখিল পাকিস্তানের মুসলিম লীগের ডাকে এক অধিবেশনে পূর্বসুরিদের অনুসারে ঘোষণা দিলেন -

'উর্দূই হবে হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা '।

এ ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস, ১১ ও ১৩ পতাকা দিবস পালিত হয়।সেখান থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণায় ভীত হয়ে সরকার ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে সকল প্রকার সভা,মিছিল, মিটিং ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেন।কিন্তু বাংলার ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে রাজপথে নামে।মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে আসতেই পুলিশের গুলিতে সালাম,রফিক,জব্বার,বরকত সহ  আরও অনেকে শহীদ হন।এই ভাষার জন্য এই ভাষা শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থেই নির্মান করা হয় শহীদ মিনার।

প্রথম শহীদ মিনারঃ

২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া সেই মর্মাহত ঘটনা সাড়া দেশের জনগণকে আরও শক্তি বৃদ্ধি করেছিল।তাই সেই ভাষার জন্য জীবন দান করা ভাষাশহীদদের মর্যাদার জন্য,তাদের স্মৃতি রক্ষার জন্য এবং তাদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছাত্রজনতা একটি শহীদ মিনার তৈরি করে।শহীদ শফিউলের পিতা ২৪ শে ফেব্রুয়ারি এই প্রথম শহীদ মিনার টি উদ্ভোদন করেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগুষ্টি এটি মেনে নিতে পারি নি। তার কিছু দিন পরেই পাকিস্তানিরা সেই শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে।কিন্তু ভেঙে ফেলতে পারিনি বাঙালির মন থেকে,মুছে ফেলতে পারিনি শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতি। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাষায়-

"ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙ্গুক 
একটি মিনার গড়েছি মোরা চার-কোটি পরিবার"।

বর্তমানের শহীদ মিনারঃ

বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনারটি ধংস করার পরে আজকের এই শহীদ মিনারটির নকশা করেন স্থপতি হামিদুর রহমান। পরবর্তীতে শহীদ মিনার টি আরও সংষ্কার করা হয়। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আমরা যে শহীদ মিনার টি দেখি সেই শহীদ মিনার টি হামিদুর রহমানের চুড়ান্ত নকশার পরিপূর্ণ রূপ।প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ এই মিনারটির সামনে দাঁড়িয়ে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।শহীদ মিনার এখন শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনেই নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ  স্থানে এই শহীদ মিনার নির্মান করা হয়।

শহীদ মিনারের তাৎপর্যঃ

"প্রভাত ফেরি প্রভাত ফেরি 
আমায় নেবে সঙ্গে 
বাংলা আমার বচন, 
আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।"

শহীদ মিনারের মিনার ও তার স্তম্ভ গুলো মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার তথা মা ও তার শহীদ সন্তানের প্রতিক।এবং শহীদ মিনার আমাদের বাঙালির জাতির জীবনের প্রতিটি আন্দোলনের প্রতিক।এই মিনার আমাদের প্রেরণা জোগায়।মাঝখানের সব চেয়ে উচু স্তম্ভটি মায়ের নির্দশন হিসেবে পরিচয় বহন করে।সন্তানের প্রতিক হিসেবে রয়েছে চার পাশের চারটি ছোট স্তম্ভ। এই সন্তানেরাই অকাতরে জীবন দিয়ে নিজের ভাষা রক্ষা করেছিল।আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেও শহীদ মিনার বাঙালিদের সাহস জুগিয়েছেল যা আমাদের প্রেরণার মূল অংশ হিসেবে কাজ করেছে।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে  আমাদের বিজয়ের প্রেরণা আমাদের একুশের চেতনা। আমরা যখনই অন্যায়ের শিকার হই, তখনই শহীদ মিনার আমাদের নতুন প্রেরণা জোগায়।

শহীদ মিনার ও আমাদের সংকৃতিঃ

শহীদ মিনার আজ কেবল একুশের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই-আমাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িয়ে পরেছে।বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য দলে দলে বাঙালীরা সমাবেত হয় শহীদ মিনারের সামনে। শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ধরনের জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেশের কোনো বরেণ্য ব্যাক্তিদের জীবনাবাসন হলে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কিছু সময় শহীদ মিনারে প্রঙ্গনে রাখা হয়। এইভাবেই শহীদ মিনার আজ আমাদের সংকৃতির একটি অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

শহীদ মিনাকে ঘিরে বাঙালির কর্মসূচিঃ

বাঙালি জাতির কাছে শহীদ মিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ গৌরবের বিষয়। একুশের ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণ বিভিন্ন রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়।এবং বাংলাদেশের পতাকা ঠিক শহীদ মিনারের কাছে উত্তলন করা হয়।শহীদ মিনারকে সামনে রেখে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় এবং সকল শহীদের স্মরণ করা হয়।এবং শহীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের চরনে ফুল অর্পন করা হয়।সারা শহীদ মিনার ফুলে ফুলে ভরে যায়।শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি নয়,স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস সব কর্মসূচি এই ভাবেই পালন করে থাকে বাঙালি। এবং সব শেষে সবাই মিলে কুচকাওয়াজ ও মিছিলে বের হয়।প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ভাবে শ্রদ্ধা করা হয় ও এইভাবে কর্মসূচি পালন করা হয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি  লাভঃ

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে অনেক তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকত সহ অনেকেই। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।এই দিনটি শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বের মানুষ এই দিনটিকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানায় ভাষা শহীদের।

 শহীদ মিনার আন্তর্জাতিক  স্বীকৃতি লাভের ইতিহাসঃ

কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।সে সময় সেক্রেটারী জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। পরে রফিক, আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজিভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড”-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর কানাডীয় দূত ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করা হয়।

১৯৯৯ সালে তারা জোশেফের সাথে ও পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন, আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ – কানাডা , ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে। তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দানে ২৯টি দেশ অনুরোধ জানাতে কাজ করেন।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়  এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।

উপংহারঃ

"মাগো, ওরা বলে 
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে 
গল্প শুনতে দেবে না।
বল মা, তাই কি হয়?
তাই তো আমার দেরি হচ্ছে।"
-আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

এটি কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর বিখ্যাত কবিতার এক ভাষা শহীদের রক্তে ভেজা চিঠি। যেটা তার মাকে লিখেছিল, কিন্তু তার আগেই সে শহীদ হয়ে গেছে।

শহীদ মিনার আমাদের প্রেরণার অন্তহীন উৎস।বাঙালিরা শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে তাদের সমৃদ্ধ অতিতের কথা স্মরণ করে।আর বর্তমান প্রোজন্মের কাছে গর্ব করে সে কথা বলতে পারি আমরা। আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে শিকৃতি পেয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়,এই মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় সারা বিশ্বে।যে শহীদ মিনার পাকিস্তানিরা ভেঙ্গে ফেলেছিল তা আজ বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত।

হাবিবা আফরিন

আমার নাম হবিনা আফরিন । ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি আমার শখ। sorolmanus.com আমার সেই শখ পুরণে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আশা করছি আমার লেখার মাধ্যমে আপনারা উপকৃত হবেন। সবাই আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Ads

Ads