ভূমিকা
আমাদের জাতীয় জীবনে ১৬ই ডিসেম্বর সবচেয়ে আনন্দ ও গৌরবের একটি দিন। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এই দিনে আমাদের প্রিয় স্বদেশ দখলদার মুক্ত হয়েছিল। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা বিজয়ী অর্জন করেছিলাম।পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করেছিলাম। এই দিনটি তাই আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। এটি আমাদের বিজয় দিবস।
★বিজয় দিবসের ইতিহাস
বিজয় মহান কিন্তু বিজয়ের জন্য সংগ্রাম মহত্তর।প্রতিটি বিজয়ের জন্য কঠোর সংগ্রাম প্রয়োজন। আমাদের বিজয় দিবসের মহান অর্জনের পেছনেও বিয়ের বাঙালির সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্ট এরপর প্রথম থেকে বাঙ্গালীদের মনে প্রতিমা শ্বসন থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছা জাগরণ ঘটে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নানা আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। অবশেষে বাঙালি স্বাধীনতার ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। বাঙালির স্বাধীনতার ন্যায্য দাবিকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য ১৯৭১ সালে ২৫ শে রাত পশ্চিমা সামরিক জান্তাবাহিনী বাঙালির নিধনে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, সাহিত্যিক, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান- বৌদ্ধ -খ্রিস্টান সবাইকে নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী।যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ মাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে। সুদীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয় যুদ্ধের মুক্তিযুদ্ধ চলে পাকিস্তানের সামরিক জল্লাদরা এ সময় গ্রামে-গঞ্জে- শহরে বন্দরে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে নিরীহ জনগণকে। ঘরবাড়ি দোকান পাঠ লুট করে জ্বালিয়ে দেয়। মা বোনেদের উপর পাশবিক নির্যাতন করে। প্রাণ বাঁচাতে সহায়- স্বাবলম্বীহীন এক কোটি মানুষকে আশ্রয় নিতে হয় প্রতিবেশী দেশে ভারতে।তবু বাঙালি দামিনী পৃথিবী অবাক তাকিয়ে দেখে :
- সাবাস বাংলাদেশ!
- এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় :
- জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
- তবু মাথা নোয়াবার নয়
অবশেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে নেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এ দেশের মুক্তি সেনা ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সংগ্রামের অবসান ঘটে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। সূচিত হয় বাংলাদেশের মহান বিজয়।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালির জয়যাত্রা শুরু হয়। এই দিনের সপরিচয় আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ পাই। এই দিনটির জন্যই সারা বিশ্বে বাঙালি জাতীয় ও বাংলাদেশের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত।১৬ই ডিসেম্বর তাই আমাদের জাতীয় দিবস।প্রতিবছর সবই শেষে মর্যাদা নিয়ে জাতির কাছে হাজির হয় মহান দিবস। সব অন্যায় অত্যাচার শোষণ দূঃশাসনের বিরুদ্ধে বিজয় দিবস আমাদের মনে প্রেরণা সৃষ্টি করে।
বিজয় দিবসের উৎসব
১৬ ই ডিসেম্বরে ভোরের সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ পুষ্পস্তবক অর্পনের মধ্য দিয়ে দিবসটির শুভ সূচনা হয়। বাংলাদেশের জনসাধারণ মহা সমারহে বিজয় দিবস পালন করে। ১৫ই ডিসেম্বর রাত থেকে বিজয় দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি চলে।দেশের সমস্ত স্কুল কলেজ ঘরবাড়ির দোকানপাট রিক্সার গাড়ি ইত্যাদিতে শোভা পতাকায় রাস্তায় রাস্তায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বিজয়ের আনন্দে সব শ্রেণীর মানুষ যোগ দেয়। এসব অনুষ্ঠানে কোথাও কোথাও বসে বিজয় মেলা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এই দিনটি বেশ জমজমাট ভাবে পালন করা হয়।ঢাকার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যগণ কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্য বিরোধীদলীয় নেতা নেত্রী গণমানব ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ এই কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন। বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন কাঙ্গালী ভজন আয়োজন করে থাকে। অনেক সাহিত্য সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিজয় দিবস স্মরণে অনুষ্ঠান করে।পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র।বেতার ও টেলিভিশনে প্রচার করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের আত্মার শান্তি ও দেশের কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা করা হয়। শহরের সন্ধের আয়োজন করা হয় বিশেষ আলোকসজ্জার। সমগ্র দেশজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশে বিজয় দিবস পালিত হয়।
বিজয় দিবসের শিক্ষা ও আমাদের করণীয়
জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের শিক্ষা হচ্ছে দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসা এবং দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মত্যাগের শিক্ষা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেদের প্রাণ সংগ্রহ করে এ কঠিন সত্যটির প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।তাদের উত্তরসূরীর হিসেবে আমাদের উপর আজ দেশ গড়ার কঠিন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারি। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত-এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।কিন্তু এর নাগরিক জীবনে সমস্যার কোন অন্ত নেই। অশিক্ষার দারিদ্র দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আছে। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য দেশের প্রতিটি মানুষকে কাজ করতে হবে। দেশের কল্যাণ সাধন করাই হবে দেশের প্রতিটি মানুষের ব্রত। আর তা সম্ভব হলেই বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
★ বিজয় দিবসের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
পৃথিবীতে কোন মহৎ কাজেই আপনা আপনি কিংবা হঠাৎ করে ঘটে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও হঠাৎ করে কিংবা আপনা আপনি ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। অনেক আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। এজন্য আমাদের ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ও দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জত বিসর্জন দিতে হয়েছে।উদ্দেশ্য ছিল শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিবছর বিজয় দিবস আমাদের সেই স্বপ্ন সাধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে ৪৬ টি বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়ে গেলেও আজও শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। আমরা এখনো দারিদ্রকে জয় করতে পারিনি, পারিনি স্বচ্ছতা ও সততাপূর্ণ গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সুশাসিত রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে।
এক শ্রেণীর স্বার্থন্বেষী মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। তাদের অপোৎপরতায় ঘুষ, দুর্নীতি, বলপ্রয়োগ বা ভয় প্রদর্শন, প্রভাবখাটানো এবং জনপ্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহারে প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সর্বক্ষেত্রে অপরাধপ্রবণতা, সামাজিক অস্থিরতা ও অসন্তোষ বিরাজ করছে । দেশের রাজনীতি অনেকটা সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসনির্ভর রাজনৈতিক দলের সদস্যরা দেশের অবকাঠামগত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ, দেশপ্রেমহীনতা দেশের অস্তিত্ব কে বিপন্ন করে তুলছে। এমনই অবস্থায় বিজয় দিবস অনেকটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। যা একটি স্বাধীন দেশের প্রেক্ষাপটে কখনোই কাম্য হতে পারে না।
★ উপসংহার
দীর্ঘ তিন যুগের স্মৃতি জড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ পদার্পণ করেছে আশা ও আনন্দের একটি নতুন শতাব্দীতে। বাংলাদেশ এখন নয় কোন শিশু রাষ্ট্র, নয় কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ।প্রাপ্তির আলোয় আজ প্রত্যাশাকে দেখার সময়, সামনে এগিয়ে যাবার পরমক্ষন, ভবিষ্যৎ স্বপ্নের মুহূর্ত। তাই বিগত বছরগুলো সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে তা থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে।শপথ নিতে হবে সুখী সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের।